বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের উদ্যোগ নিচ্ছে ঢাকা। মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে সম্প্রতি আদালত এই রায় দিয়েছে। তবে রায় কার্যকরের সবচেয়ে বড় বাধা এখন ভারত—গত শনিবার (২২ নভেম্বর) এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, একসময় ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হাসিনার রাজনৈতিক উত্থানের পেছনে ছিল তার বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার দুঃসহ স্মৃতি। তবে দীর্ঘ রাজনৈতিক যাত্রার পর তার পতন আসে ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনের মুখে, যা শেষ পর্যন্ত তাকে ভারতে পালাতে বাধ্য করে। এখন তার অনুপস্থিতিতে দেওয়া মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হবে কি না, তা নির্ভর করছে ভারতের অবস্থানের ওপর।
রায় ও পটভূমি
২০২৪ সালের ছাত্র আন্দোলন দমনে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে হাসিনা দোষী সাব্যস্ত হন। আন্দোলনের দমন-পীড়নে জাতিসংঘের হিসাবে প্রায় ১,৪০০ মানুষ নিহত হয়। আন্দোলনই শেষ পর্যন্ত তার সরকারের পতন ঘটায়। এরপর ১৫ বছরের শাসনের অবসানে গত বছরের আগস্টে তিনি ভারতে আশ্রয় নেন।
বিশ্লেষক মুবাশ্বর হাসান বলেন, “তিনি জনরোষ এড়াতে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। ভারতে আত্মগোপনের মধ্যে মৃত্যুদণ্ড পাওয়াটা এক বিরল ঘটনা।”
রক্তাক্ত অতীত ও ক্ষমতার লড়াই
১৯৭৫ সালের সামরিক অভ্যুত্থানে পরিবার হারানোর পর হাসিনার দীর্ঘ নির্বাসন তাকে ভারতের প্রতি আস্থাশীল করে তোলে। ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে তিনি আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন এবং শুরু হয় তার ও খালেদা জিয়ার মধ্যকার দীর্ঘ রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা।
১৯৯৬ সালে প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ২০০৮ সালে পুনরায় ক্ষমতায় ফিরে তিনি আরও কঠোর, কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণধর্মী শাসন কায়েম করেন। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়লেও মানবাধিকার, গণমাধ্যম স্বাধীনতা ও বিরোধী দলের ওপর দমন-পীড়নের অভিযোগ বাড়তে থাকে। ভারতের প্রতি তার দৃঢ় অবস্থান দিল্লির জন্যও কৌশলগত সুবিধা বয়ে আনে।
ছাত্র আন্দোলন ও পতন
সরকারি চাকরির কোটা সংস্কার আন্দোলন দ্রুত দেশজুড়ে বিক্ষোভে রূপ নেয়। কঠোর দমন-পীড়নও আন্দোলন থামাতে ব্যর্থ হয়। রাষ্ট্রীয় সহিংসতার অভিযোগই পরবর্তীতে হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার ভিত্তি হয়ে ওঠে।
মৃত্যুদণ্ডের রায়
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল হাসিনার অনুপস্থিতিতেই বিচার করে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। অভিযোগ ছিল—বিক্ষোভকারীদের হত্যায় উসকানি, কঠোর দমন-পীড়নের নির্দেশ এবং ড্রোন, অস্ত্র ও বিমান ব্যবহার করে আন্দোলন দমন করার আদেশ দেওয়া।
রায় ঘোষণার পর নিহতদের পরিবার আদালতে স্বস্তি প্রকাশ করে। এক আন্দোলনকারীর বাবা বলেন, “পূর্ণ শান্তি পাব যখন তাকে ফাঁসির দড়িতে দেখব।”
ভারতের ভূমিকা
ভারত রায়ের প্রতিক্রিয়ায় নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়েছে। হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ বলেন, “ভারত সবসময় ভালো বন্ধু। তারা আমার মায়ের জীবন বাঁচিয়েছে।”
তবে ভারতের সাবেক কূটনীতিক অনিল ত্রিগুনায়েত মনে করেন, দিল্লি তাকে ফেরত পাঠাবে না। ভারত-বাংলাদেশ প্রত্যর্পণ চুক্তি অনুযায়ী রাজনৈতিক অপরাধে কাউকে ফেরত না পাঠানোর সুযোগ রয়েছে। তার মতে, “ভারত অভিযোগগুলোকে রাজনৈতিক অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করতে পারে।”
তিনি আরও জানান, হাসিনা এখনো সুপ্রিম কোর্টে বা আন্তর্জাতিক আদালতে আপিল করতে পারেন। তাই ভারত কোনো সিদ্ধান্তে তাড়াহুড়ো করবে না।
এদিকে রায়ের পরদিন বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাকে ফেরত পাঠাতে ভারতের কাছে পুনরায় অনুরোধ জানিয়েছে, চিঠিতে উল্লেখ—“হাসিনাকে ফিরিয়ে দেওয়া ভারতের দায়িত্ব।”
পরবর্তী রাজনীতির গতিপথ
আগামী ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের আগে এই রায় দেশের রাজনীতিতে বড় প্রভাব ফেলতে পারে। আওয়ামী লীগ এখন নিষিদ্ধ, নেতৃত্ব শূন্য। নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার রাজনৈতিক বিভাজন কমানোর চ্যালেঞ্জ নিয়ে কাজ করছে।
বিএনপিসহ অন্যান্য দল রাজনৈতিক সুযোগ নিতে পারে। আওয়ামী লীগ ভবিষ্যতে পুনরায় সক্রিয় হতে চাইলে সেটি আর হাসিনার নেতৃত্বে হবে না—বলছে বিশ্লেষণ। এখন প্রশ্ন—এই রায় কি অতীতের এক যুগের সমাপ্তি, নাকি নতুন অস্থিরতার সূচনা?
একুশে সংবাদ//এ.জে



একুশে সংবাদের সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

