শারদীয় দুর্গোৎসবের আমেজে রঙিন সারা দেশ। পূজামণ্ডপ সাজছে আলো আর প্রতিমার আভায়। তবে কিশোরগঞ্জের কটিয়াদীর আড়িয়াল খাঁ নদপাড়ে বসেছে ভিন্ন এক উৎসব—বিখ্যাত ঢাকের হাট। চার শতাব্দীর ঐতিহ্যবাহী এই হাটে বিক্রি হয় না কোনো বাদ্যযন্ত্র, বরং ভাড়া হয় ঢাকির দল।
শুক্রবার সকাল থেকেই জমে ওঠে হাট। এক পাশে ঢাক, ঢোল, কাঁসর, সানাই, বাঁশি, খঞ্জরি ও করতাল বাজিয়ে নিজেদের নৈপুণ্য দেখান বাদকরা। অন্য পাশে মনোযোগ দিয়ে শুনছেন পূজারি ও আয়োজকরা। কার তালে দেবীর আগমন হবে আরও মহিমান্বিত, তার ওপরই নির্ভর করছে চুক্তির অঙ্ক। দাম উঠছে ১০ হাজার থেকে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত।
মুন্সিগঞ্জ থেকে সাতজনের দল নিয়ে এসেছেন হরি রাজ। ৩০ বছর ধরে এ হাটে আসছেন তিনি। পরিবার ছেড়ে আসতে কষ্ট হলেও ঢাকই তাঁর রুটি-রুজি। এবারের পূজায় ভালো বায়নার আশায় আছেন তিনি। বিক্রমপুরের সজিব দাসের দলের দাবি এক লাখ বিশ হাজার টাকা। তার আক্ষেপ, আগের মতো জৌলুস আর নেই হাটে। কারও স্বপ্ন পরিবারের মুখে হাসি ফোটানো, কারও লক্ষ্য সন্তানের পড়াশোনার খরচ মেটানো। কুমিল্লার মোহাম্মদ আলীর আটজনের দল এসেছে ৯০ হাজার টাকার চুক্তির আশায়।
মিঠামইনের নারায়ণ সূত্রধর প্রতিবছর এখান থেকেই ঢাকি ভাড়া করেন। এবারের দাম কিছুটা বেশি বলে জানান তিনি।
স্থানীয়দের মতে, এই হাটের জন্ম ষোড়শ শতকে। তখন সামন্ত রাজা নবরঙ্গ রায় দুর্গাপূজার জন্য ঢাকি খুঁজতে বিক্রমপুরে বার্তা পাঠাতেন। নৌকায় নৌকায় ঢাকি এসে ভিড়ত ব্রহ্মপুত্রের যাত্রাঘাটে। রাজা নিজে দাঁড়িয়ে শুনতেন তাদের বাজনা এবং সেরা দলকে দিতেন পুরস্কার। সেই আয়োজন ধীরে ধীরে হাটে রূপ নেয়, পরে স্থান বদলে কটিয়াদীর পুরাতন বাজার এলাকায় বসতে শুরু করে।
প্রতিবছর প্রায় ৬০০ ঢাকি এ হাটে আসেন। যারা চুক্তিবদ্ধ হতে পারেন না, তাদের বাড়ি ফেরার গাড়ি ভাড়া দেওয়া হয়। কটিয়াদী পৌর পূজা উদযাপন পরিষদের সেক্রেটারি জনি কুমার সাহা বলেন, “এই হাট ধর্ম-বর্ণের সীমা ছাড়িয়ে বাঙালির উৎসবে পরিণত হয়।”
কিশোরগঞ্জ শহরের দর্শনার্থী দিপেন ভৌমিক জানান, “অনেক শুনেছি ঢাকের হাটের নাম, এবার সরাসরি দেখে অভিভূত।”
কটিয়াদী মডেল থানার ওসি তরিকুল ইসলাম জানান, বাদক ও পূজা আয়োজকদের নিরাপত্তায় মোবাইল টিম নিয়োজিত রয়েছে। স্থানীয় কৃষ্ণধন গোস্বামী বলেন, কয়েক শতাব্দী ধরে এই হাট টিকে আছে স্থানীয়দের সহযোগিতায়।
শুধু পূজার আয়োজন নয়, এই হাট এখন বাঙালির সাংস্কৃতিক স্মৃতি। দেবী দুর্গার প্রতিমায় আগমন মুহূর্তে ঢাকিদের তালে পূর্ণতা পায় শারদীয় উৎসবের আনন্দ।
একুশে সংবাদ/এ.জে