বাংলাদেশে প্রতিবছর পাঁচ হাজারের বেশি মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন; যার প্রায় ৭০ শতাংশের কারণ অতিরিক্ত গতি ও নিরাপত্তা সরঞ্জামের ঘাটতি। বক্তারা বলছেন, মৃত্যুহার কমানোর বৈশ্বিক প্রতিশ্রুতি থাকা সত্ত্বেও দেশে এখনো কার্যকর সড়ক নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন হয়নি—তাই জরুরি আইনগত ও কাঠামোগত পদক্ষেপ নিতে হবে।
সোমবার (১ ডিসেম্বর) রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে জাতীয় হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ আয়োজিত ‘টেকসই উন্নয়নে সড়ক নিরাপত্তা আইন : বাংলাদেশ পরিপ্রেক্ষিত ও করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়।
বক্তাদের বক্তব্য
বক্তারা জানান, ২০৩০ সালের মধ্যে রোডক্র্যাশজনিত মৃত্যু অর্ধেকে নামিয়ে আনতে হলে এখনই সমন্বিত সড়ক নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন জরুরি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) রোডক্র্যাশকে প্রতিরোধযোগ্য অসংক্রামক রোগ হিসেবে চিহ্নিত করেছে, যা নীতি পরিবর্তন ছাড়া নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের রোড সেফটি ইনজুরি অ্যান্ড প্রিভেনশন প্রোগ্রামের ম্যানেজার মোহাম্মদ ওয়ালী নোমান। তিনি বলেন—বিআরটিএসহ বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, সড়ক দুর্ঘটনার ৭০ শতাংশই ঘটে অতিরিক্ত গতি ও নিরাপত্তা সরঞ্জামের অভাবে।
তিনি ‘সেফ সিস্টেম অ্যাপ্রোচ’ বাস্তবায়নের গুরুত্ব তুলে ধরে জানান, নিরাপদ সড়ক, নিরাপদ গতি, নিরাপদ যানবাহন ও নিরাপদ সড়ক ব্যবহারকারীর সমন্বয়ে দুর্ঘটনা কমানো সম্ভব—যা বিশ্বে বহু দেশ সফলভাবে করেছে।
গবেষণা ও আর্থিক ক্ষতি
২০২৩ সালের সিআইপিআরবি–ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের গবেষণা তুলে ধরে তিনি জানান—দুর্ঘটনায় আহতদের বড় অংশ প্রথমে যান প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে, যেখানে জরুরি সেবা সীমিত। হাসপাতালে শয্যার ১৬.২% দখল করেন দুর্ঘটনা–আহত রোগীরা। প্রতিজন রোগীর গড় চিকিৎসা ব্যয় ৩১,৬৮৩ টাকা—যা পরিবারকে বড় আর্থিক সংকটে ফেলে।
তরুণদের অভিমত
মুক্ত আলোচনায় তরুণরা বলেন, রোডক্র্যাশ এখন তরুণদের মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ। তারা স্মরণ করিয়ে দেন—মরক্কোয় অনুষ্ঠিত গ্লোবাল মিনিস্টেরিয়াল কনফারেন্সে বাংলাদেশ ২০২৭ সালের মধ্যে সড়ক নিরাপত্তা আইন এবং ২০২৬ সালের মধ্যে গতিসীমা ব্যবস্থাপনা নির্দেশিকা প্রণয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, যা বাস্তবায়নে ধীরগতি দেখা যাচ্ছে।
সরকারের অবস্থান
সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব নিখিল কুমার দাস বলেন, সড়ক দুর্ঘটনায় দেশের প্রায় প্রতিটি পরিবারই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর ফলে দেশের জিডিপির প্রায় ৩% ক্ষতি হয়। তার মতে, দুর্বল ল্যান্ড ইউজ প্ল্যানিং এবং কৃষিজমি–জলাশয় সংরক্ষণ নীতিতে অসংগতি সড়ক নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে।
তিনি জানান, দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের দ্রুত উদ্ধার ও চিকিৎসা নিশ্চিতে প্রায় ৫,০০০ কোটি টাকার একটি সড়ক নিরাপত্তা প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে—যার অর্থায়ন করছে বিশ্বব্যাংক। দুর্ঘটনার পর দ্রুত অ্যাম্বুলেন্স বা পুলিশ ভ্যান পাঠানোই এ প্রকল্পের মূল লক্ষ্য।
ডেটা সিস্টেমের দুর্বলতা
বাংলাদেশ রোড সেফটি প্রজেক্টের (বিআরএসপি) প্রজেক্ট ম্যানেজার ডা. নুসায়ের চৌধুরী বলেন, দেশের ডেটা সিস্টেম অত্যন্ত দুর্বল। ২০২০ সালে পুলিশের হিসাব ৫,০৮৪ মৃত্যু—আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দেখিয়েছে ৩১ হাজার! নির্ভরযোগ্য তথ্য না থাকায় কার্যকর সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।
তিনি জানান, বিআরএসপি প্রজেক্টের মাধ্যমে নতুন তথ্য সংগ্রহ পদ্ধতি চালু হচ্ছে। ১২ জেলায় ট্রমা রেজিস্ট্রি পাইলট করা হচ্ছে—যেখানে রিকশা থেকে হাইওয়ে পর্যন্ত সব দুর্ঘটনার তথ্য এক প্ল্যাটফর্মে নথিভুক্ত হবে।
পোস্ট-ক্র্যাশ রেসপন্স জোরদারে কুইক রেসপন্স টিম (কিউআরটি) গঠন হচ্ছে। প্রতি ২০ কিলোমিটারে থাকবে অ্যাম্বুলেন্স, মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট ও প্রশিক্ষিত ড্রাইভারসহ ২৪ ঘণ্টার সেবা। প্রথমে ২০০ কিলোমিটার এলাকায় পাইলট হিসেবে চালু হবে এই ব্যবস্থা।
একুশে সংবাদ/ সাএ



একুশে সংবাদের সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

