২০২৪ সালের মাঝামাঝি সময় ছাত্র আন্দোলন দমনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে নিরাপত্তা বাহিনীকে `প্রাণঘাতী অস্ত্র` ব্যবহারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল—এমন দাবি করছে বিবিসির অনুসন্ধানী ইউনিট ‘বিবিসি আই ইনভেস্টিগেশন’। একটি ফাঁস হওয়া অডিও ক্লিপের সূত্র ধরে তারা এ তথ্য তুলে এনেছে।
বিতর্কিত এই অডিওটি চলতি বছরের মার্চ মাসে অনলাইনে ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে এক নারীকণ্ঠে, যেটিকে শেখ হাসিনার বলে দাবি করা হচ্ছে, স্পষ্টভাবে বলতে শোনা যায়: “যেখানেই পাবে, গুলি করবে।”
বিবিসি জানিয়েছে, ক্লিপটি যাচাই করে তাদের নিরপেক্ষ ফরেনসিক বিশ্লেষকরা এটি আসল বলে নিশ্চিত করেছেন এবং এর মধ্যে কোনো ধরনের এডিট বা কৃত্রিমতা পাওয়া যায়নি।
এই অডিও ক্লিপটি বর্তমানে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংক্রান্ত একটি আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে মূল প্রমাণ হিসেবে ব্যবহারের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। মামলাটি শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতেই চলছে, যেহেতু তিনি বর্তমানে ভারতে অবস্থান করছেন।
১৮ জুলাই ২০২৪ সালে শেখ হাসিনার গণভবনে অবস্থানকালে ফোনালাপটি রেকর্ড করা হয় বলে জানিয়েছে একটি সরকারি সূত্র। এটি ধারণ করেছিল ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশনস মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি)। পরে এটি কে বা কারা ফাঁস করে অনলাইনে প্রকাশ করে, তা এখনো নিশ্চিত নয়।
অডিওর নিরপেক্ষ বিশ্লেষণে যুক্তরাজ্যভিত্তিক ফরেনসিক প্রতিষ্ঠান ‘এয়ারশট’ জানায়, ক্লিপটির শব্দতরঙ্গ, ব্যাকগ্রাউন্ড নয়েজ ও বৈদ্যুতিক ফ্রিকোয়েন্সি বিশ্লেষণে এটি অবিকৃত এবং প্রাকৃতিকভাবে রেকর্ডকৃত বলেই প্রতীয়মান হয়।
বাংলাদেশের সিআইডি-ও তাদের নিজস্ব যাচাইয়ে অডিওতে শোনা যাওয়া কণ্ঠকে শেখ হাসিনার কণ্ঠস্বর বলেই চিহ্নিত করেছে।
জাতিসংঘের তথ্যমতে, গত গ্রীষ্মে আন্দোলন দমনে প্রায় ১,৪০০ জন প্রাণ হারান। যাত্রাবাড়ীর ঘটনাটি সবচেয়ে রক্তাক্ত ছিল, যেখানে মাত্র একদিনেই পুলিশের গুলিতে ৫২ জন নিহত হন বলে বিবিসির তদন্তে উঠে এসেছে—যদিও শুরুতে এই সংখ্যা ৩০ বলা হয়েছিল।
ওই সময়ে আন্দোলনের কেন্দ্রে থাকা সেনাবাহিনী সরিয়ে নেওয়ার পরপরই পুলিশ বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে নির্বিচারে গুলি চালায় বলে জানা গেছে। সেই সহিংসতার পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় যাত্রাবাড়ী থানা পুড়িয়ে দেওয়া হয় এবং এতে কয়েকজন পুলিশ সদস্য নিহত হন।
আইনি অগ্রগতি ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
শেখ হাসিনাসহ তৎকালীন সরকারের ২০৩ জনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযোগ আনা হয়েছে। তাদের মধ্যে ৭৩ জন বর্তমানে কারাগারে আছেন।
আন্তর্জাতিক আইনজীবী টবি ক্যাডম্যান, যিনি ট্রাইব্যুনালে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে যুক্ত, বলেছেন:“ফাঁস হওয়া অডিওটি যাচাই ও বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ হিসেবে কাজ করবে।”
অন্যদিকে, আওয়ামী লীগ দাবি করেছে, অডিওর সত্যতা নিশ্চিত নয় এবং সেটি বাস্তবতার বিকৃতি হতে পারে। তারা এই তদন্ত ও অভিযোগগুলোকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে অভিহিত করেছে।
শেখ হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে, যার নেতৃত্বে রয়েছেন অর্থনীতিতে নোবেল জয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনুস। সরকারটি বর্তমানে একটি জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে তাতে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ নিশ্চিত নয়।
একুশে সংবাদ/আ.ট/এ.জে