আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হওয়ায় বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণি বর্তমানে মারাত্মক আর্থিক সংকটে পড়েছে। মূল্যস্ফীতি, আয় বৈষম্য বৃদ্ধি, এবং সীমিত আয়ের কারণে জীবনযাত্রা কঠিন হয়ে পড়েছে, যার ফলে সঞ্চয় কমে যাচ্ছে এবং ঋণগ্রস্ত হওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। দেশে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে লাগামছাড়া ঘোড়ার মতো।
এসব নিম্নআয়ের মানুষের জন্য বাড়তি চাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। উচ্চ বাড়িভাড়া, মাত্রাতিরিক্ত গ্যাস, বিদ্যুৎ বিলসহ নিত্যব্যবহারের সবকিছুর দাম বাড়ার কারণে দুর্বিষহ হয়ে উঠছে নাগরিক জীবন। আয় যে হারে বেড়েছে, তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি হারে বাড়ছে ব্যয়। বিশেষ করে নিম্নআয়ের মানুষ যা আয় করছে তা দিয়ে জীবনধারণ করা কষ্টসাধ্য হয়ে উঠছে। স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, শিক্ষার জন্য খরচ করার মতো টাকা তাদের হাতে থাকছে না। খরচের চাপ সামাল দিতে তারা কম খাচ্ছেন।
রাশিয়া-ইউক্রেন সংকট, অস্বাভাবিক ডলারের দাম, দেশের অভ্যন্তরে সব ধরনের জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি এ চাপ বাড়িয়েছে। আমদানি, উৎপাদন খরচ ও পরিবহন খরচ বাড়ায় দফায় দফায় দাম বাড়ানোর সুযোগ তৈরি হয়েছে। সুযোগ কাজে লাগিয়ে বাজারে জেঁকে বসেছেন সিন্ডিকেটকারীরা। ফলে বাজারে চাল, ডাল, তেল, চিনি, পেঁয়াজ, আদা, মসলা, সবজির দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে।
নিম্নআয়ের মানুষ বলছে, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে তাদের জীবন ওষ্ঠাগত। সংসার চালাতে পারছেন না। খাদ্যপণ্য কিনতেই আয়ের সব টাকা চলে যাচ্ছে। অন্য মৌলিক চাহিদা যেমন- বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসার খরচ কমাচ্ছে মধ্য ও নিম্নবিত্ত মানুষ। নিত্যপণ্যের দাম দিন দিন বেড়েই চলছে। যার ফলে জনসাধারণের খেয়ে পরে বেঁচে থাকাই যেন কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হওয়ায় চাপের মুখে নাগরিক জীবন। আরমান নামে এক ব্যবসায়ী বলেন, জমা বলতে কিছু নেই। হবে কীভাবে, আগে ১৫ হাজার টাকায় যেই বাজার করতাম সেটা এখন করতে গেলে ৩০ হাজার লাগে। এখন শুধু রোজকার করি আর খাই। একজন রিকশাচালক বলেন, সংসারে খরচ বেশি, সব কিছুর দাম বেশি। ইনকাম করি ৫০০, খরচ হয় ৬০০ টাকা। ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। চাকরিজীবী রাকিব আকন্দ জানান, টানাপোড়নের মধ্যে টেনেটুনে সংসার চলে। চাকরিজীবীদের নির্ধারিত বেতনের মধ্যে বৈধ আয়ে সংসার চলেনা।
রাজধানীর মিরপুরে এক সন্তান নিয়ে বসবাস করেন গার্মেন্টস কর্মী স্বর্ণা আক্তার। তিনি বলেন, গরু-খাসির মাংস অনেক আগেই কেনা বাদ দিয়েছি। এখন ডিম-দুধও খাওয়া যাচ্ছে না। মেয়ের টিউশনি খরচ দিতে পারছি না। এভাবে চলতে থাকলে যে বাসায় থাকছি, সেটাও ছাড়তে হবে। অসুস্থ হলে বাড়ি থেকে টাকা আনতে হয়। দ্রব্যমূল্য বাড়ায় প্রতি মাসের খরচ বেড়েছে। এভাবে চলতে থাকলে গ্রামে চলে যেতে হবে।
একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান জরিপের তথ্য জানিয়ে বলেন, বাজারে দিনের পর দিন জিনিসপত্রের দাম বাড়তে থাকায় খাদ্যাভ্যাস বদলে ফেলেছে নিম্নআয়ের মানুষ। তারা কম খাচ্ছেন। ৯৬ দশমিক ৪ শতাংশ পরিবার মাংস খাওয়া কমিয়েছেন এবং ৮৮ দশমিক ২২ শতাংশ পরিবার মাছ কম খাচ্ছে। তাদের গবেষণা তথ্যে জানা গেছে, নিম্নআয়ের পরিবারে খরচ বেড়েছে গড়ে ১৩ শতাংশ। এ সময় তাদের আয় বাড়েনি। বাধ্য হয়ে অনেক পরিবার খাবারের গুণগত মানেও ছাড় দিচ্ছে। অর্থাৎ আগের চেয়ে কম দামের খাবার কিনে খাচ্ছে। সারাদিন না খেয়ে থাকছেন- এমন দরিদ্র মানুষের হার ১৮ শতাংশ।
এই গবেষণা সংস্থার পক্ষ থেকে বলা হয়, আমরা দেখেছি, সংসারে খরচ বেড়ে যাওয়ায় পরিবারগুলো স্বাস্থ্য খাতে ব্যয়ে কাটছাঁট করছে। অনেকে জমি বিক্রি করে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এছাড়া আমিষে কাটছাঁটের কারণে শিশুরা অপুষ্টিতে ভুগবে। এসব সমস্যা দীর্ঘমেয়াদি। শুধু ওই পরিবারের জন্য নয় বরং দেশের জন্যও। এদিকে সরকারের নজর দেওয়া জরুরি। মূল্যস্ফীতি হচ্ছে প্রান্তিক মানুষের জন্য করের সবচেয়ে নিষ্ঠুরতম ধরন। দরিদ্র মানুষকে সুরক্ষা দিতে হলে বিকল্প উৎস প্রয়োজন। খাদ্যপণ্যের দাম সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতে হবে। আরও বিস্তৃত করতে হবে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকারি হিসাবের চেয়েও প্রকৃত মূল্যস্ফীতি অনেক বেশি। গত বছরের জুনের বাজারদর অনুযায়ী- ঢাকার কেন্দ্রস্থলে বসবাসরত একজন ব্যক্তির মাসিক খাবার খরচ পাঁচ হাজার ৩৩৯ টাকা। চারজনের একটি পরিবারের ক্ষেত্রে এ খরচ হচ্ছে ২১ হাজার ৩৫৮ টাকা। এরপর দেশের দ্রব্যমূল্য আরও বেড়েছে। সেই হিসাব মাথায় নিলে জনপ্রতি খরচ আরও প্রায় এক থেকে দেড় হাজার টাকা বাড়বে।
বাংলাদেশের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ মধ্যবিত্ত, যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ২৫ শতাংশ। এই মধ্যবিত্তরাই ইউরোপে রেনেসাঁ ঘটিয়েছিল। এখানেও এমন কিছু ঘটাতে চাইলে তাদের দিয়েই ঘটাতে হবে। আর তাদের দিয়ে এমন কিছু ঘটাতে চাইলে তাদের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে অবগত থাকা প্রয়োজন। তাদের সাথে সংশ্লিষ্ট সমস্যাগুলো সমাধান করা গেলে লক্ষ্য অর্জন অসম্ভব।
মধ্যবিত্তরা বর্তমানে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে আছে। তাই তাদের বেঁচে থাকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। মধ্যবিত্ত পরিবারের মাসিক যা আয় হয় তা দিয়ে একটি পরিবারের বাসা ভাড়া দিয়ে বাচ্চাদের পড়াশোনার খরচ মিটিয়ে বাকি টাকা দিয়ে বর্তমান বাজার প্রেক্ষাপটে প্রয়োজনীয় পুষ্টিগুণ সম্পন্ন খাবারের ব্যবস্থা করা ঐ পরিবারের পক্ষে অসম্ভব। তার উপর আছে খাদ্যপণ্যসহ অন্যান্য পণ্যে অতিমাত্রায় বিষাক্ততা। সেই সাথে আছে বসবাসের অনুপযোগী চরম অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। এখানকার বাতাস দূষিত, পানি দূষিত এবং মাটি দূষিত। এই পরিস্থিতিতে এদেশের মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠী টিকে থাকবে কি না তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। অপুষ্টিতে আক্রান্ত অথবা অসুস্থ মধ্যবিত্ত নাগরিকদের নিয়ে কোনভাবেই উন্নত দেশ গঠন সম্ভব নয়। তাদের দিয়ে কিছু করাতে চাইলে আগে তাদের সুস্বাস্থ্য ও সুস্থতা নিশ্চিত করতে হবে। তাদের মস্তিষ্ককে উদ্ভাবনী ও কৌশলী বানাতে হলে তাদের জন্য ভেজালমুক্ত ও স্বাস্থ্যসম্মত খাবারের যোগান দিতে হবে।
একুশে সংবাদ/এ.জে
    
                        

                                        
                                            
                                                        
                            
একুশে সংবাদের সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
												
												
												
												
												
												
												
												
                                            
                                            
                                            
                                            
                                            
                                            
                                            
                                            
