দুর্গাপূজার উৎসব শেষ হয়েছে কয়েকদিন আগে। ঢাকের বাদ্য, আরতির আলো, সিঁদুরখেলা—সব মিলিয়ে শেষ হয়েছে আনন্দোৎসবের মহোৎসব। দেবী দুর্গা ফিরে গেছেন কৈলাসে, কিন্তু গ্রামের মালাকারদের (মৃৎশিল্পীদের) ব্যস্ততা এখনো থামেনি। কারণ, বিসর্জনের পরই শুরু হয় তাদের আরেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ—প্রতিমা পুনরুদ্ধার ও মেরামতের প্রক্রিয়া।
গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় এখন দেখা যাচ্ছে এক ভিন্ন চিত্র। নদী, খাল ও পুকুরে বিসর্জন দেওয়া প্রতিমার কাঠামো ও মাটির অংশগুলো নৌকা, বাঁশ, রশি ও জাল দিয়ে সংগ্রহ করছেন স্থানীয় মালাকাররা। ভাসমান খড়, বাঁশ, কাঠ ও প্রতিমার ভগ্নাংশ তারা ঘাটে এনে আলাদা করে রোদে শুকাতে দিচ্ছেন।
স্থানীয় মৃৎশিল্পী নিতাই মালাকার বলেন, “দুর্গাপূজা শেষ মানেই আমাদের কাজের বিরতি নয়, বরং তখনই আমাদের কাজের শুরু। আমরা বিসর্জিত প্রতিমার কাঠামো তুলে এনে পরিষ্কার করি, শুকিয়ে রাখি। আগামী বছর নতুন প্রতিমা গড়তে এসব কাঠামোই কাজে লাগে।”
তিনি আরও বলেন, “এভাবে করলে খরচ কম হয়, সময়ও বাঁচে। কাঠামো ঠিক থাকলে শুধু মাটি ও রঙের কাজ করলেই চলে।”
এ সময় মৃৎশিল্পীদের ঘাটে ব্যস্ততা চোখে পড়ার মতো। কেউ বাঁশ কেটে কাঠামো মজবুত করছেন, কেউ খড় গুছিয়ে রাখছেন, আবার কেউ শুকনো মাটি ভেঙে মিহি করে পরবর্তী বছরের ব্যবহারের জন্য সংরক্ষণ করছেন। চারপাশে ছড়িয়ে আছে ভেজা মাটির গন্ধ, শুকোতে থাকা খড়ের স্তূপ আর শ্রমে ভরা মুখগুলো।
মালাকারদের ভাষায়, প্রতিমা বিসর্জনের সময় যেমন ভক্তদের চোখে জল আসে, ঠিক তেমনি কয়েকদিন পর সেই প্রতিমাই আবার ফিরে আসে শিল্পীদের হাতে। তারা জানান, বিসর্জিত প্রতিমার কাঠামো একেবারে ফেলে দেওয়া হয় না। মাটির অংশ খুলে কাঠ, বাঁশ ও খড় আলাদা করে শুকিয়ে রাখা হয়। এরপর পরবর্তী বছরে সেই কাঠামোর ওপর নতুন করে মাটি লাগিয়ে তৈরি হয় নতুন প্রতিমা।
স্থানীয় বাসিন্দা তাপস মহন্ত বলেন, “বিসর্জনের পর মালাকারদের এমন পরিশ্রম সত্যিই প্রশংসনীয়। তারা শুধু প্রতিমা তৈরি করেন না, একধরনের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখছেন।”
প্রতিমা পুনরুদ্ধারের এই প্রক্রিয়া কেবল অর্থনৈতিক নয়, ধর্মীয় ভক্তিরও প্রতিফলন। ভাঙা প্রতিমার কাঠামোর মধ্যেই শিল্পীরা খুঁজে পান নতুন সৃষ্টির অনুপ্রেরণা।
এ সময় চারদিকে দেখা যায় কর্মব্যস্ততার মনোমুগ্ধকর দৃশ্য—কেউ প্রতিমার দড়ি টানছেন, কেউ কাঠামো শুকাচ্ছেন, কেউ আবার রঙ ও অলংকার খুলে নিচ্ছেন। শিশু-কিশোররা কৌতূহল নিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে দেখছে প্রিয় দেবীর পুনর্জন্মের সূচনা।
মৃৎশিল্পীদের মতে, এই সময়টাই পরবর্তী পূজার প্রস্তুতির শুরু। তাদের পরিশ্রম, দক্ষতা ও ভক্তির মেলবন্ধনে সৃষ্টি হয় নতুন জীবনের প্রতিমা—যা আগামী বছরের দুর্গাপূজায় আবারও ভক্তদের পূজিত হবে মন্দিরে।
একুশে সংবাদ/এ.জে