AB Bank
ঢাকা সোমবার, ২০ মে, ২০২৪, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

সরকার নিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল

Ekushey Sangbad
ekusheysangbad QR Code
BBS Cables
Janata Bank
  1. জাতীয়
  2. রাজনীতি
  3. সারাবাংলা
  4. আন্তর্জাতিক
  5. অর্থ-বাণিজ্য
  6. খেলাধুলা
  7. বিনোদন
  8. শিক্ষা
  9. তথ্য-প্রযুক্তি
  10. অপরাধ
  11. প্রবাস
  12. রাজধানী

বাহা পরব: আদিবাসী সাঁওতালদের বসন্ত উৎসব


বাহা পরব: আদিবাসী সাঁওতালদের বসন্ত উৎসব

আর মাত্র কদিন পরেই শুরু হচ্ছে আদিবাসী সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর বসন্তের উৎসব- বাহা পরব।


বাংলাদেশে বসবাসরত যেকোন আদিবাসী জনগোষ্ঠীর নাম শুনলেই আমাদের সামনে কিছু সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের চিত্র ভেসে ওঠে। প্রত্যেকটি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর রয়েছে নিজ নিজ ঐতিহ্যনির্ভর উৎসব বা পর্ব। শুধু তাই নয়, প্রায় সকল আদিবাসী জনগোষ্ঠীর আসল পরিচয় বলতে সাধারণ্যে সাংস্কৃতিক পর্বগুলোই সর্বাগ্রে বিবেচিত হয়ে থাকে। যেমন, সহরাই, কারাম, ফাগুয়া, সাংগ্রে পোয়ে, ওয়াংগালা, সিরুয়া বিসুয়া, টুসু প্রভৃতি উৎসবের কথা মনে হলেই আমাদের আর বুঝতে অসুবিধা হয় না যে এগুলো সুনির্দিষ্টভাবে এক একটি জনগোষ্ঠীকে নির্দেশ করছে। 

কালের প্রবাহে এসব জনগোষ্ঠীর  লোকজনের জীবনচর্যায় অনেক পরিবর্তন সাধিত হলেও তাদের চিরাচরিত সংস্কৃতির স্থানটি অক্ষত রয়ে গিয়েছে। এজন্যই তো এরা আদিবাসী- আদি নিয়ে বসবাস যাদের।
বাংলাদেশের সমতলের আদিবাসীদের মধ্যে সাঁওতাল জনগোষ্ঠী বৃহত্তম। দেশের উত্তরের জেলাগুলোতে তাদের বসবাস। তন্মধ্যে রাজশাহীর গোদাগাড়ী, তানোর ও পবা, নওগার নিয়ামতপুর, সাপাহার, মান্দা ও মহাদেবপুর, চাপাই নওয়াবগঞ্জের নাচোল ও গোমস্তাপুর, গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ, দিনাজপুরের বোঁচাগঞ্জ, বিরল, নওয়াবগঞ্জ, পার্বতীপুর, চিরিরবন্দর, ফুলবাড়ী এবং ঠাকুরগাঁওয়ের রাণীশঙ্কাইল প্রভৃতি উপজেলার গ্রামসমূহে সাঁওতালদের বসবাস অধিক।
 
সাঁওতাল জনগোষ্ঠীতে পালিত প্রধান উৎসবগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বাহা পরব।  বাহা শব্দের বাংলা অর্থ  হলো ফুল; আর পরব মানে উৎসব বা অনুষ্ঠান। তাই বাহা পরব মানে হলো ফুলের উৎসব। আমরা সকলেই জানি, শীতে বৃক্ষরাজির পাতা ঝরে গিয়ে বসন্তে আবারো নতুন পুষ্পপত্রপল্লবে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে; যার ফলে প্রকৃতি এক নতুন ও মোহনীয় সাজে সজ্জিত হয়। প্রকৃতির এই নতুন রূপমালাকে আবাহন করাই বাহা পরবের মূল উদ্দেশ্য। সাঁওতালদের ধারণামতে, দেবদেবীরা প্রকৃতির মধ্যেই বিরাজমান থাকেন। বাহা পরব তাই শুধু নাচ-গান বা আনন্দ উদযাপনের উৎসব নয়, এর প্রধান অনুষঙ্গ হলো পূজা ও প্রার্থনা।


যেকোন জাতির যেকোন উৎসবের পেছনে শুধু সংস্কৃতির চর্চাই নয়, বরং সামাজিক, অর্থনৈতিক,  রাজনৈতিক বা ধর্মীয় প্রেরণা ক্রিয়াশীল থাকে। বাঙ্গালী জাতির নববর্ষ, নবান্ন প্রভৃতি এক্ষেত্রে সাক্ষাৎ দৃষ্টান্ত। অনুরূপভাবে, বাহা পরবেরও একটি আর্থ-সামাজিক তাৎপর্য রয়েছে। সাঁওতালদের বর্ণনা অনুসারে, প্রকৃতি যেমনিভাবে ফুলেফলে রঙ্গীন হয়ে উঠেছে, তা যেন অক্ষুন্ন থাকে যাতে করে বছর জুড়ে সকলের আনন্দ, সুখ ও শান্তি বিদ্যমান থাকে। আর, মনেপ্রাণে সে প্রার্থনাই করা হয় পূজার মধ্যে। প্রাচীন কালের মানুষ ছিল সম্পূর্ণরূপে প্রকৃতিনির্ভর। এই নির্ভরতা থেকেই প্রকৃতি পূজার উৎপত্তি। প্রকৃতি সদয় হলে শস্য ভাল হবে, খাদ্য নিরাপত্তা বজায় থাকবে, দুর্যোগ কম হবে, শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা বিরাজমান থাকবে- এই ধারণা ও বিশ^াস থেকে সাঁওতালরা পূর্বের মতই এই উৎসবের আয়োজন করে থাকেন। আর, উৎসবের আয়োজন সংক্রান্ত যেকোন সিদ্ধান্তগ্রহণে গ্রামের সকলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়, মতামত গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়; যা সমাজের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা ও আন্তরিকতা বৃদ্ধি করে এবং এটি  গণতান্ত্রিক আচরণেরই প্রকাশ।  


বসন্তের পূর্ণিমা (দোল উৎসব) তিথিকে কেন্দ্র করে এই পূজা (বোঙ্গা) বা পরবের আয়োজন করা হয়। পরবের ক’দিন আগে থেকেই সাঁওতালরা তাদের বাড়ীঘর পরিচ্ছন্ন করে নানা ধরনের বর্ণিল আল্পনা এঁকে ঘরদোরের সৌন্দর্য বৃদ্ধির কাজ শুরু করে দেন। দিন যত ঘনিয়ে আসে ঘরে ঘরে খুশীর আমেজ ততই বাড়তে থাকে, এলাকাজুড়ে সাজ সাজ রব পড়ে যায়।


সহরাই (পৌষপার্বন)-এর পর থেকে বাহা পরব পর্যন্ত সাঁওতালরা বিয়েসহ যেকোন শুভকর্মের আয়োজন করেন না। তারা বিশ^াস করেন, বাহা পূজা বা বোঙ্গা না হওয়া অবধি বিয়ের আয়োজন করলে নানা ধরনের অমঙ্গল চলে আসে। কোন পরিবারে এহেন অনুষ্ঠান নিতান্ত জরুরী হয়ে পড়লে বাহা পূজার বিধিবিধান সম্পন্ন করেই তা আয়োজন করতে হয়।


এলাকাবাসী সকলের মতামতের ভিত্তিতে নির্ধারিত দিনে ও সময়ে এবং নির্ধারিত স্থানে পূজার আয়োজন করা হয়। পূজা অনুষ্ঠানের স্থানকে বলা হয় ‘জাহের থান’। দু’জন অবিবাহিত পুরুষ পবিত্র থেকে মহুয়া ও শালফুল তুলে নিয়ে আসেন। গ্রামের লোকজন মাটির পাত্রে বিশুদ্ধ জল নিয়ে মাঝি বা মাতব্বরদের সাথে জাহের থান-এ মিলিত হন। সেখানে প্রধান পূরোহিত বা নাইকে বাবার হাতে কাঁসার থালায় থাকে শালফুল। পূজার আনুষ্ঠানিকতা সেরে নাইকে বাবা নাগরা বাজিয়ে বাড়ীতে বাড়ীতে যান। বাড়ীর নারী সদস্যরা ঘটিতে পরিস্কার জল ও বাটিতে সরিষার তেল, কাঁসার থালা ও বসার পিড়ি নিয়ে তাঁর আগমনের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। নাইকে বাবা বাড়ীতে প্রবেশ করার পর পরই তিনিসহ আগত মুরুব্বীদের পা ধুইয়ে দেওয়া হয়। পরিচ্ছন্ন কাপড়ে মুছিয়ে দিয়ে তেল মেখে দেওয়া হয়। পরে নাইকে বাবা শালফুল ও জল পরিবারের সদস্যদের স্পর্শ করিয়ে দেন যাতে করে সকলের আনন্দ ও শান্তি অটুট থাকে। এই ফুল খোঁপায় গেঁথে নারীরা বছরের ফুল পরা শুরু করেন। জানা যায, বাহা পরবের আগে সাঁওতালরা ফল খান না ও ফুল পরেন না।


সাঁওতাল নারীরা এ উপলক্ষ্যে বাহারী বস্ত্র পরিধান করেন এবং রঙ্গিন ফুল ও পত্রে সজ্জিত হন। তারা বাহা পরবের ক’দিন নাচ-গান করে আনন্দ উপভোগ করেন। আত্মীয়-স্বজনের বাড়ী বেড়ানোও এ সময়ের এক আনন্দের বিষয়। নানা ধরনের খাবার-দাবাররের আয়োজনও করা হয় এ পরবকে উদ্দেশ্য করে। বাহা পরব উপলক্ষ্যে নানা স্থানে মেলা বসে, যা সার্বজনীন রূপ পেয়ে থাকে। কোন কোন স্থানের মেলা একাধিক দিন ধরেও চলে।


সাঁওতাল ছাড়াও আরো কিছু আদিবাসী জনগোষ্ঠীতে এই উৎসবের আয়োজন পরিলক্ষিত হয়। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের দোল উৎসব এবং সিলেট অঞ্চলে বসবাসরত চা শ্রমিক ও আরো কিছু জনগোষ্ঠীর ফাগুয়া উৎসবের সাথে এই বাহা পরবের বেশ মিল খুঁজে পাওয়া যায়।


বাহা পরবের তাৎপর্য ও বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে কথা হয় সাঁওতাল নেতা ও জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সাধারণ সম্পাদক শ্রী গণেশ মার্ডির সাথে। তিনি বলেন, ‘বাহা পরবের আধ্যাত্মিক তাৎপর্য আগের মতই রয়েছে। কিন্তু সামাজিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় প্রভৃতি নানা কারণে অনুষ্ঠানের আয়োজনে আগের জাঁকজমক ভাব এখন অনেকটাই কমে এসেছে। তবে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খণ্ড প্রভৃতি অঞ্চলে পরবটি মনোমুগ্ধকর সাজসজ্জা ও ভাবগাম্ভীর্যের সাথে পালিত হয়ে থাকে, যা সকলের নজর কাড়ে।’ আমরা চাই, সাঁওতালদের এই পরবটি আরোও সুন্দর হয়ে উঠুক, পরিপূর্ণতা লাভ করুক। কারণ তাদের প্রার্থনা ও গানে সমাজের সকলের কল্যাণের কথাই বিধৃত হয়ে ওঠে।    

 

একুশে সংবাদ/বিএইচ

Link copied!