দুই দিনের সফরে ভারতে এসেছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে তার এই বৈঠকটি এমন এক সন্ধিক্ষণে অনুষ্ঠিত হচ্ছে, যখন ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে মস্কোর উপর পশ্চিমা চাপ তীব্র হয়েছে। অন্যদিকে, ইউক্রেন সংঘাত অবসানে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে আলোচনাও চালাচ্ছে।
ভারত-রাশিয়া বহু দশক ধরে ঘনিষ্ঠ মিত্র। মস্কোর ওপর নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও নয়াদিল্লি এখনো রাশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত অংশীদার। তবে, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে রাশিয়ার উপর চাপ সৃষ্টি করতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের উপরও চাপ বাড়িয়েছে, বিশেষত রাশিয়া থেকে তেল কেনা বন্ধ করার জন্য ওয়াশিংটন উঠেপড়ে লেগেছে।
রাশিয়ার জন্য ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি। প্রায় দেড়শো কোটি জনসংখ্যার ভারত পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম অপরিশোধিত তেলের ভোক্তা এবং দ্রুততম অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী দেশ। ইউক্রেন যুদ্ধের আগে ভারতের তেল আমদানির মাত্র ২.৫ শতাংশ আসতো রাশিয়া থেকে। তবে নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়া যখন বিপুল ছাড়ে তেল বিক্রি করতে শুরু করে, তখন এই হার এক লাফে ৩৫ শতাংশে পৌঁছে যায়।
কিন্তু অক্টোবর মাসে ট্রাম্প প্রশাসন ভারতীয় পণ্যের উপর অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে। ওয়াশিংটন বলে, রাশিয়া থেকে তেল কিনে ভারত মস্কোর যুদ্ধ তহবিলে অর্থায়ন করছে। ফলস্বরূপ, ভারত রাশিয়া থেকে তেল কেনা কমিয়েছে। প্রেসিডেন্ট পুতিন এই সফরে ভারতকে তেল সরবরাহ অব্যাহত রাখার অনুরোধ জানাবেন বলে মনে করা হচ্ছে।
তেলের পাশাপাশি, রাশিয়ার জন্য ভারতের কাছে অস্ত্র বিক্রিও এক বড় বিষয়। পুতিনের সফরের আগে থেকেই খবর ছিল যে ভারত রাশিয়া থেকে অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান ও আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কেনার পরিকল্পনা করছে। রাশিয়া বর্তমানে শ্রমিকের ঘাটতিতে ভুগছে, তারা ভারতকে দক্ষ শ্রমিকের উৎস হিসেবেও দেখছে।
ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে, ক্রেমলিন এই সফরের মাধ্যমে পশ্চিমা দেশগুলোকে দেখাতে চায় যে ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে তাদের বিচ্ছিন্ন করার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। চীনে শি জিনপিংয়ের সঙ্গে বৈঠকের পর নয়াদিল্লিতে মোদির সঙ্গে পুতিনের সাক্ষাৎ বহু-মেরুকেন্দ্রিক বিশ্ব ধারণায় মস্কোর শক্তিশালী মিত্রদের সমর্থনকে তুলে ধরে।
প্রেসিডেন্ট পুতিনের এই সফর প্রধানমন্ত্রী মোদি এবং ভারতের বৈশ্বিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ সময়ে এসেছে। ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য রাশিয়াকে সমালোচনা করতে পশ্চিমা চাপ থাকা সত্ত্বেও মোদি বরাবরই সংলাপের মাধ্যমে সংঘাত সমাধানের পক্ষে অবস্থান নিয়ে ভারতের কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন প্রদর্শন করেছেন।
তবে, ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে ফেরার পর ভারত-মার্কিন সম্পর্ক তলানিতে ঠেকেছে, যার মূল কারণ হলো শুল্ক নিয়ে অচলাবস্থা। এই পরিস্থিতিতে পুতিনের সঙ্গে মোদির বৈঠক ভারতের ভূ-রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসনের এক কঠিন পরীক্ষা। মোদিকে একইসঙ্গে ওয়াশিংটনের চাপ সামলে মস্কোর সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করতে হবে, যাতে দেশে ও আন্তর্জাতিক মহলে তাঁর মিত্রদের কাছে বার্তা যায় যে তিনি পুতিনকে এখনও বন্ধু মনে করেন। আবার, এই সম্পর্ক যেন আমেরিকা ও ইউরোপের সঙ্গে ভারতের চলমান বাণিজ্য আলোচনাকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে।
ভারত-রাশিয়া দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ২০২৩ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত রেকর্ড ৬ হাজার ৮৭২ কোটি ডলারে পৌঁছেছে, যার অধিকাংশই অবশ্য রাশিয়ার কাছ থেকে ভারতের তেল কেনার কারণে। এই বিশাল বাণিজ্য ভারসাম্যহীনতা কমানো মোদির অন্যতম লক্ষ্য।
প্রতিরক্ষা খাত দুই দেশের বাণিজ্যের একটি সহজ পথ। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে ভারতের প্রতিরক্ষা আমদানিতে রাশিয়ার অংশীদারিত্ব কমলেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ সামরিক প্ল্যাটফর্ম এখনো রাশিয়ার উপর নির্ভরশীল। মে মাসে পাকিস্তানের সঙ্গে সীমিত সশস্ত্র সংঘর্ষে এস-৪০০-এর মতো রুশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার কার্যকারিতা প্রমাণ হয়েছে। তবে নিষেধাজ্ঞার কারণে এস-৪০০-এর সরবরাহ সময়সীমা পিছিয়ে ২০২৬ পর্যন্ত হওয়ার খবরে ভারত উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
মোদি এই সফরে রাশিয়ার অর্থনীতিতে ভারতীয় পণ্যের জন্য জায়গা তৈরি করতে চাইবেন, যাতে তেল ও প্রতিরক্ষা বাদে অন্যান্য খাতেও বাণিজ্য বৃদ্ধি পায়। বিশ্লেষকদের মতে, এই সফর কেবল স্নায়ুযুদ্ধের সময়ের কূটনীতির পুনরাবৃত্তি নয় বরং এটি ঝুঁকি, সরবরাহ শৃঙ্খল এবং অর্থনৈতিক সুরক্ষার বিষয়ে আরও জটিল কিছু।
একুশে সংবাদ/এসআর



একুশে সংবাদের সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

