সরকার ও প্রশাসনের প্রতি রাজারবাগ দরবার শরীফের মহিলা আনজুমানের আহবান-পর্দানশীন মহিলাদের পর্দার সাথে রাষ্ট্রীয় সুবিধা ও নাগরিক অধিকার প্রাপ্তির ব্যবস্থাকরন ও পর্দানশিন নারীদের পরিচয় শনাক্তে পর্দার বিধান রক্ষা করে আধুনিক ও আইনসম্মত বায়োমেট্রিক পদ্ধতি (যেমন ফিঙ্গারপ্রিন্ট) ব্যবহারের কার্যক্রম চালু করতে হবে। সেইসঙ্গে সংগঠনটি এও দাবি করেছেন যে, সরকারি অফিসে পর্দানশিন নারীদের সুবিধার্থে নারী কর্মকর্তা/কর্মচারী রাখতে হবে।
সোমবার (২১ মার্চ) জাতীয় প্রেস ক্লাবের আবদুস সালাম হলে এক সংবাদ সম্মেলনে মহিলা আনজুমান, রাজারবাগ দরবার শরীফের সদস্য শারমিন ইয়াসমিন এসব দাবি জানান।
সংবাদ সম্মেলনে মহিলা আনজুমানের আলোচকরা পর্দানশীন মহিলাদের পর্দার সাথে সকল রাষ্ট্রীয় সুবিধা ও নাগরিক অধিকার সুনিশ্চিতের দাবী তোলেন।
সংবাদ সম্মেলনে আলোচনা করেন, রাজারবাগ দরবার শরীফের মহিলা আনজুমানের সদস্য ও আজকের অনুষ্ঠানের আহবায়ক শারমিন ইয়াসমিন। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন রাজারবাগ দরবার শরীফের মহিলা আনজুমানের সদস্য সুমাইয়া আহমদ, মাশহুরা ফিরদাউসীসহ আরো শতাধিক পর্দানশীন মহিলা।
আলোচক শারমিন ইয়াসমিন বলেন, বাংলাদেশে অসংখ্য পর্দানশীন মহিলা আছেন, যারা পবিত্র কোরআন-সুন্নাহ অনুসারে পরিপূর্ণ পর্দা করার চেষ্টা করেন। তারা কোন গায়েরে মাহরামকে চেহারা দেখান না। অথচ রাষ্ট্রের একজন নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পেতে জাতীয় পরিচয় পত্রসহ বিভিন্ন কাগজ করার সময় সনাক্ত করার জন্য চেহারা খুলে ছবি তুলতে হয় এবং গায়েরে মাহরাম পুরুষকে তার চেহারা দেখায় নিশ্চিত করতে হয়, এটি তার ছবি। পর্দানশীন হওয়ায় এসব মহিলারা চেহারা খুলে ছবি তুলছেন না বা গায়েরে মাহরাম পুরুষকে চেহারা দেখাচ্ছেন না। এতে তারা জাতীয় পরিচয়পত্রসহ কোন সরকারী কাগজ তৈরী করতে পারছেন না এবং কোন নাগরিক অধিকারও লাভ করতে পারছেন না। পরিস্থিতি বেশি জটিল হয়ে উঠছে বিধবা, তালাকপ্রাপ্তা মহিলা বা প্রবাসীদের স্ত্রীদের জন্য। কারণ সামান্য সহযোগীতার জন্য তারা নিকটস্থ মাহরাম পুরুষকে কাছে পাচ্ছেন না। এমন অবস্থায় সন্তান-সন্ততি নিয়ে জীবন ধারণ তাদের জন্য বেশ জটিল হয়ে উঠেছে। আলোচনার সময় উপস্থিত ছিলেন রহিমা আহমদ নামক একজন বিধবা, ত্বহিরা জাহান নামক একজন প্রবাসীর স্ত্রী, শিল্পী আহমদ নামক একজন স্বামী পরিত্যক্তা এবং মার্জিয়া আহমদ নামক একজন অসুস্থ ব্যক্তির স্ত্রীর, যারা প্রত্যেকেই পর্দানশীন মহিলা হওয়ায় চেহারা খুলে ছবি তুলে জাতীয় পরিচয়পত্র করতে পারেনি, যাদের নিকটস্থ মাহরাম পুরুষ না থাকায় তাদের প্রত্যেকের জীবনে তৈরী হয়েছে মানবিক সংকট।
সংবাদ সম্মেলনের আলোচক বলেন, কোরআন সুন্নাহ অনুসারে পরিপূর্ণ পর্দা করার কারণে মুখ খুলে ছবি তুলতে রাজী না হওয়ায় এরকম আরো অনেক পর্দানশীন মহিলারা অনেক রাষ্ট্রীয় সুবিধা ও নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। যেমন- ১. সরকার অনুমোদিত প্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা করা, ২. চাকরির আবেদন করা, ৩.অনলাইনে ট্রেনের টিকিট কাটা, ৪.বাসা ভাড়া নেয়া, ৫. সম্পত্তির উত্তোরাধিকার হওয়া, ৬. জমি রেজিস্ট্রি করা, ৭.সন্তানের বৃত্তির টাকা উত্তোলন করা, ৮. সন্তান স্কুলে ভর্তি করানো, ৯. ব্যাংক লেনদেন করা, ১০. জমি ক্রয়-বিক্রয় করা, ১১. ওএমএস কার্ড করা, ১২. স্বামীর পেনশনের টাকা তোলা, ১৩. জরুরী কাজে বাইরে গেলে হোটেল ভাড়া করা, ১৪. ট্রেড লাইসেন্স করা, ১৫. বিদ্যুৎ বিল দেয়া, ১৬. বিধবা ভাতা, বয়স্ক ভাতা তোলা। ১৭.মোবাইল ব্যাংকিং করা ১৮.দেশের অভ্যন্তরে প্লেনের টিকিট কাটা, ১৯.সন্তানের জন্ম নিবন্ধন করা, ২০. নমিনি হওয়া।
আলোচক বলেন, সংবিধানের মৌলিক অধিকার অংশের ৪১।(১) অনুচ্ছেদের- (ক) অংশে বলা হয়েছে, “প্রত্যেক নাগরিকের যে কোন ধর্ম অবলম্বন, পালন বা প্রচারের অধিকার রহিয়াছে”। সংবিধানের এ অনুচ্ছেদ অনুসারে একজন পর্দানশীন মহিলার পরিপূর্ণ পর্দা করার অধিকার রাষ্ট্রই তাকে দিয়েছে এবং পর্দা করাকে তার মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, সংবিধানের এ অনুচ্ছেদকে লঙ্ঘন করে জাতীয় পরিচয় পত্রসহ বিভিন্ন কাগজপত্র তৈরীতে সনাক্তকরণের নামে মহিলাদের ধর্ম পালনের অধিকার হরণ করা হচ্ছে, তাও একটি অযৌক্তিক কারণ অর্থাৎ চেহারার ছবি দেখে সনাক্তকরণ করতে। অথচ পরিচয় সনাক্তকরণে ছবি নির্ভুল কোন মাধ্যমই না। পৃথিবীতে দুই জন মানুষের চেহারা প্রাকৃতিকভাবেই এক রকম হতে পারে। যেমন, দুই জমজ ভাই বা দুই জমজ বোনের চেহারা এক রকম হতে পারে। আবার কৃত্তিম উপায়েও দুইজনের চেহারা এক রকম করা সম্ভব। পাশাপাশি বিভিন্ন পরিস্থিতিতে একজন মানুষের চেহারায়ও ভিন্নতা আসতে পারে। যেমন- বয়স, স্বাস্থ্য ও শারীরিক অবস্থার ভিন্নতার কারণে একজনের চেহারার ছবিতে অমিল লক্ষ্য করা যায়। এ সমস্ত কারণে সনাক্তকরণে নির্ভুলতার দণ্ডে ছবি অনেকটাই গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে। উপরন্তু ছবিকে সনাক্তকরণের মাধ্যম করায় অনেক অপরাধী পার পেয়ে যাচ্ছে, এবং নিরাপরাধ লোক নির্যাতিত হচ্ছে। যেমন- ২০১৯ সালে আলোচিত জাহালম নামক এক ব্যক্তির কথা আপনাদের মনে থাকার কথা। ব্যাংক জালিয়াত সালেকের সাথে চেহারায় মিল থাকায় যিনি ৩ বছর বিনা অপরাধে জেল খেটেছিলেন।
উক্ত সংবাদ সম্মেলনে আলোচক আরো বলেন, সনাক্তকরণে ছবির ব্যর্থতায় তাই আধুনিক যুগে তাই বহুল ব্যবহৃত পদ্ধতি হয়ে উঠেছে বায়োমেট্রিক পদ্ধতি। প্রযুক্তি নির্ভর এ পদ্ধতিতে সনাক্তকরণ প্রায় শতভাগ নির্ভুল। বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে সনাক্তকরণে কখনই দুই ব্যক্তির মধ্যে মিল পাওয়া যায় না। বয়স বা শারীরিক অবস্থার সাথেও এই পদ্ধতিতে কোন তারতম্য ঘটে না। উদাহরস্বরূপ, বায়োমেট্রিক পদ্ধতি, যেমন-ফিঙ্গারপ্রিন্ট সনাক্তকরণ নিয়ে বলা যায়, পৃথিবীতে যদি ৭০০ কোটি মানুষ থাকে, তবে একজনের সাথে অন্যজনের ফিঙ্গারপ্রিন্ট কখনই মিলবে না। এমনকি দুইজন জমজ ব্যক্তিরও ফিঙ্গারপ্রিন্টও হবে ভিন্ন। তাই আধুনিক যুগে অপরাধী সনান্তকরণে ফিঙ্গারপ্রিন্ট অধিক গ্রহণযোগ্য ও নির্ভুল মাধ্যম হিসেবে বিশ্বজুড়ে বহুল ব্যবহৃত হচ্ছে। ফিঙ্গারপ্রিন্ট ব্যবহারের সুবিধাও অনেক। একজন মানুষ কোথাও গেলে আইডি কার্ড ভুলে বাসায় ফেলে আসতে পারে, হারিয়েও ফেলতে পারে। কিন্তু হাতের আঙ্গুল কখনই সে ফেলে আসে না বা হারিয়ে ফেলে না। মূলতঃ ছবি দিয়ে সনাক্তকরণ পদ্ধতি ত্রুটিযুক্ত হওয়ার কারণেই “জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন, ২০১০”- এ ছবি দিয়ে সনাক্তকরণের বদলে বায়োমেট্রিক সনাক্তকরণকেই গ্রহণ করা হয়েছে। তারপরও ছবির মত একটি পুরাতন ও ত্রুটিযুদ্ধ পদ্ধতি ধরে রাখার জন্য অসংখ্য পর্দানশীন মহিলা মৌলিক অধিকার হরণ করা হচ্ছে, বঞ্চিত করা হচ্ছে রাষ্ট্রের নাগরিকত্বের স্বীকৃতি থেকে, যা সত্যিই একটি অমানবিক বিষয়।
সংবাদ সম্মেলনে আলোচকরা সরকার প্রশাসনের কাছে ২টি দাবী উত্থাপন করে বলেন-
১) পর্দানশীন মহিলাদের সনাক্তকরণে পর্দার বিধান লঙ্ঘন হয় না, এমন পদ্ধতিতে জাতীয় পরিচয় পত্র, জমি রেজিস্ট্রেশন, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, ওএমএস কার্ড, বয়স্কভাতা, বিধবা ভাতা কার্ড ইত্যাদি তৈরীর ব্যবস্থা করে দিতে হবে। এক্ষেত্রে সনাক্তকরণে পুরাতন ও ত্রুটিপূর্ণ ছবি পদ্ধতির বদলে আধুনিক ও আইনসম্মত বায়োমেট্রিক পদ্ধতি (যেমন ফিঙ্গারপ্রিন্ট) ব্যবহার করতে পারে।
২) সরকারী অফিস বা কার্যালয়ে পর্দানশীন মহিলাদের সাথে যোগাযোগ/আদান -প্রদান বা সনাক্তকরণের জন্য মহিলা কর্মকর্তা/কর্মচারির ব্যবস্থা রাখতে হবে।
একুশে সংবাদ/রা/বা/ঢা