মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে বাণিজ্যিকভাবে লটকনসহ বিভিন্ন প্রজাতির ফল চাষ করে সফল হয়েছেন সদর ইউনিয়নের ডলুছড়া গ্রামের তরুণ উদ্যোক্তা মোঃ আতর আলী। সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, ডলুছাড়া পাহাড়ি এলাকায় ১৫ বিঘা জমিজুড়ে লটকনসহ ৪০ প্রজাতির দেশি-বিদেশি ফলের বাগানে লটকন, মালটাসহ ঝুলছে বিভিন্ন জাতের ফল।
উদ্যোক্তা মোঃ আতর আলী বলেন, তিনি ৬ বছর আগে মৌলভীবাজারের আকবরপুর কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে থেকে দুইটি লটকন এর চারা এনে পরীক্ষামুলকভাবে রোপন করেছিলেন। চারা দুটিতে ফলন ভালো দেখে পরবর্তীতে বাণিজ্যিকভাবে লটকন চাষ শুরু করার পরিকল্পনা করেন। ধীরে ধীরে কলম করে ডলুছড়া পাহাড়ি টিলায় বাণিজ্যিক চাষ শুরু করেন। এখন তার বাগানে ৩৫ টি লটকন গাছ রয়েছে। এবার ৬ টি গাছে ১ হাজার কেজি ফলন পেয়েছেন। এ বছর তিনি ১০০ টাকা কেজি দরে ১ লাখ টাকার লটকন বিক্রি করেছেন। উদ্যোক্তা আতর আলী বলেন, গত মৌসুমে ৬০ হাজার টাকার লটকন বিক্রি করলেও এবছর বিক্রি বেড়েছে ৪০ হাজার। আগামী মৌসুমে তিনি কয়েক লাখ টাকার লটকন বিক্রি করে লাভের স্বপ্ন দেখছেন।
চাষি আতর আলীর বিশাল ফল বাগান ঘুরে দেখা গেছে, বাগানে লটকন ছাড়াও মালটা, কফি এরাবিকা, কফি রোবাস্টা, কাজু বাদাম, ক্যান্সার প্রতিরোধ উদ্ভিদ, আনারস, লেবু, আম, কাঁঠাল, লিচু, বেল, জাম্বুরা, কাচা মরিচ, নাগা মরিচ, কলা, সাজনাসহ বিভিন্ন প্রজাতির ফলের গাছ রয়েছে। লটকন চাষিরা জানান, একবার লটকন গাছ রোপণ করলে দীর্ঘদিন ফল পাওয়া যায়। রোগবালাই কম, পরিচর্যা সহজ ও কম খরচে লাভজনক হওয়ায় লটকন চাষে আগ্রহ বাড়ছে দিন দিন। বাজারে শ্রীমঙ্গলের লটকনের কদর অনেক। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এর সরবরাহ বাড়ছে। মৌসুমে প্রতি কেজি লটকন ৮০-১৫০ টাকা দরে বিক্রি হয়, ফলে চাষিরা প্রতি গাছ থেকে গড়ে ৪-৫ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করছেন। শ্রীমঙ্গল শহরের বিভিন্ন সড়কে, বাজারে, কলেজ েেরাড ও শহরের প্রাণকেন্দ্র চৌমোহনা চত্বরে লটকন বিক্রি করতে দেখা যায়। লটকন বাংলাদেশের অতি সুপরিচিত ফল। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত লটকন আকারে বড়, রং উজ্জ্বল ও খেতে খুব মিষ্টি হওয়ায় ক্রেতাদের মধ্যে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। লটকন এক প্রকার দেশীয় ফল, যা অতিপুষ্টি ও ওষুধী গুণে ভরপুর। ফল গোলাকার, পাকলে এর ফল হলুদ বর্ণ ধারণ করে। বাংলাদেশ ও উত্তর-পূর্ব ভারতে ফলটি, ‘বুবি’ নামে সর্বাধিক পরিচিত। ফলটি ত্রিপুরা, কাছাড় এবং বাংলাদেশ অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে ফলে। মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও বাংলাদেশে এ ফলের বাণিজ্যিক চাষ হয়। এতে প্রচুর পরিমানে ভিটামিন এ, বি, সি এবং বি-১, বি-২, বি-৩, ক্যালসিয়াম, আয়রন, ফসফরাস, পটাসিয়ম আছে।
উপজেলা কৃষি অফিস সুত্রে জানা যায়, শ্রীমঙ্গলে লটকন চাষ দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে ওঠেছে। উপজেলার সাতগাঁও, রাজঘাট, ভাড়াউড়া, কালিঘাট, ডলুছড়াসহ বিভিন্ন ইউনিয়নে এখন লটকন চাষ হচ্ছে। বিশেষ করে বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকা ও উঁচু জমিতে এই ফল চাষ করে কৃষকরা অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছেন। লটকন চাষ শুধু মৌসুমি একটি ফল নয়, বরং অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে বিশাল সম্ভাবনা তৈরি করেছে। কৃষি বিভাগের পৃষ্টপোষকতা ও সরকারি প্রণোদনা পেলে লটকন হতে পারে জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখার একটি নতুন ক্ষেত্র।
পুষ্টিবিদরা বলছেন ১০০ গ্রাম লটকনে খাদ্যশক্তি আছে ৯২ কিলোক্যালরি। প্রতি ১০০ গ্রাম লটকনে ভিটামিন সি আছে ১৭৮ মিলিগ্রাম, ক্যালসিয়াম ১৬৯ মিলিগ্রাম, শর্করা ১৩৭ মিলিগ্রাম, পটাশিয়াম ১৭৭ মিলিগ্রাম, ভিটামিন বি-১ ১৪.০৪ মিলিগ্রাম, ভিটামিন বি-২ শূন্য দশমিক ২০ মিলিগ্রাম, আমিষ ১ দশমিক ৪২ গ্রাম, লৌহ ১০০ মিলিগ্রাম, চর্বি শূন্য দশমিক ৪৫ গ্রাম আর খনিজ পদার্থ আছে ৯ গ্রাম। এতে আরও আছে ভিটামিন সি, থায়ামিন ও অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট। ফলে লটকন খেলে মুখে ঘা হয় না। শরীর সুস্থ রাখতেও ফলটি বিশেষ কাজের। এর জলীয় অংশ রক্তশূন্যতা কমায়, ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখে। এটি ত্বকের রুক্ষতা কমায়, শরীরে পানির সমতা ঠিক রাখে। এটি আর্থরাইটিস ও চর্মরোগের জন্য দারুণ উপকারী। কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতেও ভালো কাজ করে। লটকন খেলে বমিভাব কমে, খাওয়ায় রুচি বাড়ে। মানসিক চাপ কমাতেও ফলটি বিশেষ কার্যকর। তৃষ্ণা নিবারণে লটকন অতুলনীয়।
শ্রীমঙ্গল উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ মোঃ আলাউদ্দিন বলেন, শ্রীমঙ্গলের পাহাড়ি টিলা আর উর্বর লাল মাটিতে লটকনের ভালো ফলন হয়েছে। আমরা কৃষকদের পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করছি। এখানকার কৃষকরা এখন লটকন চাষকে লাভজনক অর্থকরী ফসল হিসেবে বেছে নিচ্ছেন। এই অঞ্চলের লটকন এখন ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহ করা হচ্ছে, যা স্থানীয় চাষিদের আয়ের নতুন দ্বার খুলে দিয়েছে। কৃষি কর্মকর্তা আরও বলেন, লটকন চাষে কৃষকদের ক্রমবর্ধমান আগ্রহ নিঃসন্দেহে দেশের কৃষি অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এটি শুধু কৃষকদের আয় বৃদ্ধি করবে না, বরং দেশের পুষ্টি চাহিদা টোতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
একুশে সংবাদ/মৌ.প্র/এ.জে