এবার রবি মৌসুমে রাজশাহীতে সারের সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। বিভিন্ন উপজেলায় কৃষকরা সারের জন্য হাহাকার করছেন। কোথাও কোথাও সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে প্রতি বস্তায় ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা বেশি দিয়ে সার কিনতে বাধ্য হচ্ছেন চাষিরা। অভিযোগ উঠেছে, সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানগুলো সময় মত গুদামে সার সরবরাহ না করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করছে।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক উম্মে ছালমা বলেন, চলতি মাসে (ডিসেম্বর) রাজশাহী জেলায় সারের চাহিদা ছিল ডিএপি ১৭ হাজার ১২৭ মেট্রিক টন। সেখানে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে আট হাজার ১২৪ মেট্রিক টন। আর এমওপি সারের চাহিদা ছিল ১৮ হাজার ৩৭২ মেট্রিক টন। সেখানে বরাদ্দ পাওয়া গেছে চার হাজার ২৭৮ মেট্রিক টন এবং টিএসপির চাহিদা ছিল ১৪ হাজার ২১৬ মেট্রিক টন। বরাদ্দ পাওয়া গেছে দুই হাজার ৭৩৭ মেট্রিক টন সার।
উম্মে ছালমা বলেন, ডিসেম্বর মাসের জন্য বরাদ্দ পাওয়া সার জেলার ২১৮ জন ডিলারদের মাঝে সরবরাহ করা হচ্ছে। শনিবার পর্যন্ত সরবরাহ করা হয়েছে ডিএপি তিন হাজার ২৫৪ মেট্রিক টন, এমওপি দুই হাজার ৩৬৪ মেট্রিক টন ও টিএসপি এক হাজার ৫৩৫ মেট্রিক টন। রোববার মজুদ রয়েছে ডিএপি ২২১ মেট্রিক টন, এমওপি ২৩০ মেট্রিক টন ও টিএসপি ৪১৭ মেট্রিক টন। মজুদ না থাকায় বরাদ্দকৃত সার ডিলারদের সরবরাহ করা সম্ভাব হচ্ছে না।
এদিকে, রাজশাহীর বিভিন্ন এলাকায় সারের অভাবে রবি চাষ ব্যাহত হচ্ছে। বিশেষ করে আলু চাষিরা সারের অভাবে জমি তৈরি ও বীজ রোপণ করতে পারছেন না। ফলে অনেকে এবার আলু চাষ না করে সরিষাসহ অন্য ফসলের চাষ করছেন।
রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার মোহনপুর ইউনিয়নের বিএডিসির সার ডিলার মেসার্স হিমেল ড্রেডার্স। চলতি মাসে এ ডিলার বরাদ্দ পেয়েছে ডিএপি সার ৪৫ মেট্রিক টন, এমওপি ২৮ ও টিএসপি ২০ মেট্রিক টন। কিন্তু গত ১ ডিসেম্বর এ ডিলার সরবরাহ পেয়েছে ডিএপি ৭, এমওসি ৮ ও টিএসপি ৫ মেট্রিক টন করে। এর পর গত ১৫ দিনে কোন সার তিনি সরবরাহ পাননি।
মেসার্স হিমেল ড্রেডার্সের মালিক হুমায়ুন কবির বলেন, গুদামে সার না থাকায় তারা সরবরাহ পাচ্ছেনা। ফলে কৃষকদের চাহিদা মত সার দিতে পারছিনা। যে কৃষকের ছয় বস্তা সার প্রয়োজন তাকে এক বস্তা দিয়ে ম্যানেজ করতে হচ্ছে। এতে ডিলাররা কৃষকের রোষানালেও পরছেন বলেন এই সার ডিলার।
মোহনপুর উপজেলার কেশরহাট এলাকার কৃষক রায়হান আলী জানান, গত বছর তিনি ৮ বিঘা জমিতে আলু চাষ করেছিলেন। এবার সার সংকটের কারণে তিন বিঘা জমিতে আলুর বীর রোপণ করেছেন। সরকার নির্ধারিত দামের তুলনায় প্রতি বস্তায় ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত বেশি দিয়েও সার পাওয়া যায়নি। ফলে বাকি জমিগুলোতে সরিষার আবাদ করা হয়েছে।
কৃষকরা জানিয়েছেন, চাষি পর্যায়ে ৫০ কেজির এক বস্তা ডিএপি সারের সরকারি দাম ১০৫০ টাকা। এ সার খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে হচ্ছে ১৪৫০ থেকে ১৫০০ টাকায়। আর চাষি পর্যায়ে এক বস্তা টিএসপির সরকারি দাম ১২৫০ টাকা; কিন্তু খুরচা বাজারে সেটি বিক্রি হচ্ছে ১৭০০ থেকে ১৮০০ টাকা পর্যন্ত। এছাড়াও চাষি পর্যায়ে ৫০ কেজির এক বস্তা এমওসি সরকারি দাম ১০০০ টাকা; কিন্তু রাজশাহীর বিভিন্ন এলাকায় বর্তমানে এক বস্তা চাষিদের কিনতে হচ্ছে ১৩৫০ থেকে ১৪০০ টাকায়।
বাগমারার তালতলি বাজারের খুরচা সার বিক্রেতা ইব্রাহীম হোসেন জানান, গত শুক্রবার তিনি একজন ডিলারের কাছ থেকে সার কিনেছেন। তার কাছে দাম ধরা হয়েছে ৫০ কেজির প্রতি বস্তা ডিএপি ১৩৫০ টাকা, টিএসপি ১৬৫০ টাকা ও এমওপি ১২০০ টাকা। তার গাড়ি ভাড়া লেগেছে বস্তা প্রতি ৫০ টাকা। তিনি বিক্রি করছেন গোটা বস্তা গোটা ১০০ টাকা লাভে এবং খোলা ১৫০ টাকা লাভে।
পবার আলু চাষি মাহবুবুর রহমান জানান, বাজারে আলুর চড়া দামের কারণে এবার আলু আবাদের লক্ষ্যমাত্রা বেড়েছে। আলু বীজ সংকটের মধ্যে এবার চাষিদের সার কিনতেও হিমশিম খেতে হচ্ছে। কোথাও চাহিদামতো সার পাচ্ছেন না তারা।
বিএডিসি ডিলার আসান আলী জানান, চাহিদার তুলনায় বরাদ্দ কম। উপরন্তু সরবরাহ ঠিকঠাক পাওয়া যাচ্ছে না। এছাড়াও স্থানীয় প্রভাবশালীরা বেশি পরিমাণে সার নিতে চাপ দিচ্ছেন। সব মিলিয়ে সার নিয়ে এবার বিপাকে রয়েছে ডিলাররা বলে জানান হাসান আলী।
বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশন রাজশাহী শাখার সভাপতি আবু কালাম বলেন, গোডাউনে যদি সার থাকে তা হলে কৃষকরা বরাদ্দ অনুযায়ী সার পাই। কিন্তু গোডাউনেই তো সার নেই। ডিলাররা পাবে কেমনে আর কৃষকদের দিবে কিভাবে।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে জেলায় ৩৫ হাজার ৮০০ হেক্টর জমিতে আলু আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল। কিন্তু আলুর দাম বাড়ায় এবার অতিরিক্ত আরও সাড়ে ৩ হাজার হেক্টর জমি আলু চাষের আওতায় আসছে।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক উম্মে ছালমা বলেন, চলতি আলু আবাদে চাহিদা অনুযায়ী সার বরাদ্দ চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু চাহিদার কয়েকগুন কম বরাদ্দ পাওয়া যাচ্ছে। ফলে এই সার সংকট। তবে যেটি বরাদ্দ পাওয়া গেছে ডিলাররা ঠিকঠাকমত সেটি কৃষকদের দিচ্ছে কিনা তা আমরা নিবিড় তদারকির মাধ্যমে মনিটরিং করছি। বেশি দামে সার বিক্রির অভিযোগ প্রমাণিত হলে ডিলারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
একুশে সংবাদ/বা আ/বিএইচ
আপনার মতামত লিখুন :