কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুবি) কর্মরত সাংবাদিকদের সংগঠন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির (কুবিসাস) বিরুদ্ধে `অপসাংবাদিকতা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের হয়রানি`-র অভিযোগ তুলে সংগঠনটির নিবন্ধন বাতিলের দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন শিক্ষার্থীরা।
বৃহস্পতিবার (১১ সেপ্টেম্বর) দিবাগত রাত একটার দিকে ছেলেদের তিনটি আবাসিক হল এবং আশেপাশের মেসের প্রায় দুই শতাধিক শিক্ষার্থী বিক্ষোভ মিছিল করেন। বিক্ষোভ মিছিলটি বিজয়-২৪ হল থেকে শুরু হয়। এরপর দক্ষিণ মোড় ঘুরে প্রধান ফটক হয়ে প্রশাসনিক ভবনে এসে শেষ হয়।
এসময় মিছিলে শিক্ষার্থীরা `হলুদ সাংবাদিকতার কালো হাত, ভেঙে দাও গুড়িয়ে দাও`, `হলুদ সাংবাদিকদের ঠিকানা এই ক্যাম্পাসে হবে না`, `দালালি আর করিস না রে, পিঠের চামড়া থাকবে না রে`, `বয়কট বয়কট, কুবিসাস বয়কট`, `কুবিসাসের নিবন্ধন, বাতিল চাই করতে হবে` সহ বিভিন্ন স্লোগান দেন।
জানা যায়, গত ১০ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে ১০ টার দিকে বিজয়-২৪ হলের ৩১২ নম্বর কক্ষে `বিনা অনুমতিতে বহিরাগত নারী নিয়ে প্রবেশ করার` অভিযোগ তুলে অর্থনীতি বিভাগের ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী অন্তু দাসের বিরুদ্ধে একটি সংবাদ প্রকাশ করা হয়। তবে অন্তু দাসের দাবি, ওই নারী সম্পর্কে তার খালা হন এবং সাথে খালার পরিবারও ছিল। খালার পরিবার আসার আগে সময় না পাওয়ায় হল প্রশাসনকে জানাতে পারেননি। পরবর্তীতে সাংবাদিকরা আসার পরক্ষণেই তিনি হল প্রশাসনকে অবগত করেছেন। তারপরেও সংবাদ প্রকাশ করা হয় ও সংবাদটি কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে শেয়ার করা হলে শিক্ষার্থীরা সংবাদটি নিয়ে নানা মতামত ও নিন্দা জানাতে থাকে।
উক্ত ঘটনায় বি. এম. ফয়সাল নামের এক সাংবাদিক সংবাদ প্রকাশ করে। সেই সংবাদে বিনা অনুমতিতে ছবি তুলে প্রকাশ করা হয়েছে অভিযোগ তোলে শিক্ষার্থীরা গত ১০ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাত পৌনে বারোটার দিকে ওই সাংবাদিকের রুমে (৩০৫ নং কক্ষ) যান। তখন রুমের বাকি সদস্যরা বাঁধা দিলে হট্টগোলের সৃষ্টি হয়।
পরবর্তীতে হলের প্রভোস্ট এবং হাউজ টিউটর এসে পরিস্থিতি শান্ত করেন এবং ১১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দেন। এরপর ১১ সেপ্টেম্বর প্রক্টরিয়াল বডি, হল প্রশাসন, আবাসিক শিক্ষার্থী ও সাংবাদিকদের সাথে আলোচনায় বসে। কিন্তু কোনো সমাধান না হলে তদন্ত কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়।
এরই মধ্যে ১১ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাত সাড়ে ১১ টার দিকে `বিডি টুয়েন্টিফোর টাইমস ডটকম` নামক একটি ফেসবুক পেজ থেকে `কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে খালাকে নিয়ে রুম ডেট! খবর প্রকাশের জেরে লাইট বন্ধ করে সাংবাদিক হেনস্তা` শীর্ষক একটি পোস্ট হয়। যা দেখে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। পরবর্তীতে রাত সাড়ে ১২ টার দিকে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল বের করে।
বিক্ষোভে অংশ নেওয়া বিজয়-২৪ হলের অর্থনীতি বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের আবাসিক শিক্ষার্থী রেজাউল করিম সিয়াম বলেন, `আমাদের আজকের যে অবস্থান কর্মসূচি ও বিক্ষোভ মিছিল সেটা ছিলো শুধু অপ-সাংবাদিকতার বিরুদ্ধে। এই ঘটনাকে কেউ অন্য দিকে প্রবাহিত করার চেষ্টা করবেন না। আমরা নৈতিক ও দেশের কল্যাণে সাংবাদিকতার পক্ষে সবসময়ই আছি এবং সামনেও থাকব। কিন্তু, যে সাংবাদিকতার কারণে শিক্ষার্থীরা হয়রানির শিকার হয়, মানসিক বিপর্যয় হয় এমন সাংবাদিকতা আমরা চাই না। এটা শুধু কুবিসাস নয়, অন্য কোনো সাংবাদিক সংগঠনও যদি ভবিষ্যতে এমন কাজ করে আমরা তাদেরকেও বয়কট করতে বাধ্য হব। আমরা আগামীতে আমাদের কিছু দাবি নিয়ে আমাদের উপাচার্য বরাবর স্মারকলিপি জমা দিব।`
একই হলের ব্যবস্থাপনা বিভাগের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের আরেক শিক্ষার্থী পাবেল রানা বলেন, `আমাদের এখানে আসার উদ্দেশ্য হচ্ছে অপ-সাংবাদিকতা বন্ধ করে সুষ্ঠু সাংবাদিকতা চর্চা করার আহ্বান জানানো। ক্যাম্পাসে আসার পর থেকে দেখছি অপ-সাংবাদিকতা হচ্ছে। সাংবাদিকতা মহৎ পেশা। সে জায়গা যোগ্যতা ছাড়া এখানে একটা স্মার্টফোন দিয়ে সাংবাদিক হয়ে যাচ্ছে। প্রশাসনকে বলে দিতে চাই সাংবাদিক হতে হলে নির্দিষ্ট ক্রাইটেরিয়া মানতে হবে, ন্যূনতম জ্ঞান এবং শিক্ষা ছাড়া সাংবাদিকতা করতে পারবে না। কুবিসাসের বিরুদ্ধে বিগত সময়েও আমরা দেখেছি তারা ভুল নিউজ ছড়ায়। আমরা ক্যাম্পাসে সাংবাদিকতা চাই, তবে সেটা সুষ্ঠু এবং স্বচ্ছ সাংবাদিকতা হোক।`
ফার্মেসি বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের আবাসিক শিক্ষার্থী নাঈম ভূঁইয়া বলেন, `ক্যাম্পাস সাংবাদিকতার মূল লক্ষ্য ক্যাম্পাসের সম্মান রক্ষা করা হলেও, কিছু সাংবাদিক অপসাংবাদিকতার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মান নষ্ট করছে। এর ফলে শিক্ষার্থীরা এবং তাদের পরিবার হেনস্তার শিকার হচ্ছে। সম্প্রতি একজন শিক্ষার্থীর বক্তব্য ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। সাংবাদিকদের বিশেষ সুবিধা থাকা উচিত নয়। তারা সাধারণ শিক্ষার্থীদের মতোই থাকবে। এই ধরনের অপসাংবাদিকতা বন্ধ হওয়া প্রয়োজন।`
তিনি আরও বলেন, `একজন সাংবাদিক আমার বক্তব্য ভুলভাবে উপস্থাপন করেছেন, যেখানে আমি `মব` বা `লিঞ্চিং`-এর মতো শব্দ ব্যবহার করিনি। আমার কাছে এর প্রমাণ হিসেবে রেকর্ডিংও রয়েছে। আমি এই ধরনের সাংবাদিকতার তীব্র নিন্দা জানাই এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে এর বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।`
পূর্বে `অপ-সাংবাদিকতা`র শিকার হওয়ার অভিযোগ তুলে কাজী নজরুল ইসলাম হলের আবাসিক শিক্ষার্থী আবরার ফাহিম বলেন, `আপনারা জানেন যে গত কিছুদিন আগে একটি মেসেঞ্জার গ্রুপের স্ক্রিনশট নিয়ে আমার প্রাইভেসি লঙ্ঘন করে কুবিসাস। আমার নামে একটা ন্যাক্কারজনক নিউজ করে, অথচ বহিষ্কৃত কোনো শিক্ষার্থী আমার রুমে ছিল না, সে আমার রুমে আসেনি। সে ছিল অন্য রুমে। কিন্তু একটি মেসেঞ্জার গ্রুপের হাস্যকর তথ্য নিয়ে তারা আমার নামে অপপ্রচার চালায় এবং আমার মানহানির চেষ্টা করে। একজন শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসে এসে প্রথম সেমিস্টার শেষ না করে কুবিসাসের সাংবাদিক হয়ে যায়। কোন ভিত্তিতে তারা সাংবাদিক হয় তার জবাব কুবিসাসকে দিতে হবে।`
`সংবাদ প্রকাশ`-এর জেরে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী অন্তু দাস বলেন, `গতকালের বিভ্রান্তিকর ও মানহানিকর সংবাদ প্রকাশের ঘটনায় হলে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। আজকে যাবতীয় ঘটনা নিয়ে আমাদের ও সাংবাদিকদের সঙ্গে প্রক্টর অফিসে বৈঠক হয়। তবে সমাধান না আসায় তদন্ত কমিটি গঠনের সাপেক্ষে আমাদের উভয় পক্ষকেই শান্ত থাকতে বলা হয়। কিন্তু তারপরও সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে তারা বিভিন্ন নিউজ পোর্টালে সংবাদ প্রকাশ করতে থাকে। রাতে `বিডি টুয়েন্টিফোর টাইমস ডটকম` পোর্টালে খুবই জঘন্যভাবে মিথ্যাচার ছড়ানো হয়, যা আমাকে মানসিকভাবে আরও বিপর্যস্ত করে।
তিনি আরও বলেন, `আমি আমার ক্যাম্পাসের ভাই-বোনদের কাছে অপ-সাংবাদিকতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানাচ্ছি। ভবিষ্যতে যেন আমি ও আমার পরিবারের মতো কাউকে হেনস্তার শিকার হতে না হয়।`
একুশে সংবাদ/এ.জে