একটি দীর্ঘ অপেক্ষার পর ফিরে আসে ঈদ। এক বছরের ক্লান্তিকর পড়াশোনা, ক্লাস, পরীক্ষা আর হোস্টেল জীবনের চাপ শেষে ঈদ যেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের জন্য হয়ে ওঠে এক টুকরো প্রশান্তি। এবারের ঈদও তার ব্যতিক্রম ছিল না। কেউ ছুটে গেছেন বাড়ির দিকে, কেউ আবার রয়ে গেছেন হল বা মেসে, সবাই নিজের মতো করে কাটিয়েছেন ঈদের দিনগুলো। দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থীর সেসব কথা তুলে ধরেছেন একুশে সংবাদের ডিআইইউ প্রতিনিধি - নুর ইসলাম।
জীবন স্রোতে হারিয়ে ফেলেছি শৈশব ও কৈশোরের ঈদের আনন্দ :
আমাদের মুসলিমদের অন্যতম প্রধান উৎসবের মধ্যে একটি ঈদ-উল-ফিতর। ঈদ মানে আনন্দ, ঈদ মানে খুশি, এবং প্রিয়জনদের সাথে কাটানো সোনালী মুহূর্ত। প্রতিবছরের মতো এবছরও এক মাসের সিয়াম-সাধনার পর মহান আল্লাহ তাআলার অশেষ রহমতে ঈদ-উল-ফিতর উদযাপিত হলো। আমাদের গ্রামাঞ্চলে ঈদের দিন ঈদগাহ যেন একটা মিলনমেলা, যেখানে গ্রামের বিভিন্ন বয়সী মানুষ একত্রিত হয়। ছোট, বড়, সমবয়সী বন্ধু কিংবা শহরে থাকা আত্মীয়দের সাথে দেখা হওয়া, কুশল বিনিময় করা, ছবি তোলা সবকিছুই এক অনন্য আনন্দের মুহূর্ত হয়ে ওঠে। ছোট-বড় সবার মাঝে যেন এক ফ্রেন্ড সার্কেল চোখে পড়ে। ঈদের সালাত শেষে একসাথে ঈদগাহ থেকে বাড়ি ফেরা, বিকেলে ঘুরতে বের হওয়া, রাতে বন্ধুদের সাথে আড্ডা সবকিছুই জীবনের অন্যতম সেরা মুহূর্ত হয়ে থাকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুবাদে এখন আর গ্রামে থাকা হয় না, ফলে মনে হতো, গ্রাম, গ্রাম্য বন্ধু ও আত্মীয়দের সাথে সম্পর্কের সখ্যতা ক্রমেই কমে যাচ্ছে। কিন্তু ঈদের ছুটির এই দিনগুলোতে এসব ভাবনা দূর হয়ে আমরা আবার ফিরে যাই শৈশব ও কৈশোরের সেই আনন্দময় দিনগুলোতে। চলমান জীবন স্রোতে আমরা হারিয়ে ফেলেছি শৈশব ও কৈশোরের ঈদের আনন্দ। বাস্তবতার প্রেক্ষিতে, ছোটবেলার ঈদের আনন্দ আর বর্তমান ঈদের আনন্দের মাঝে আমাদের মনে ভিন্ন এক অনুভূতি জাগে।
বড় হওয়ার সাথে সাথে নানা ধরনের পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, মানসিক এবং অন্যান্য কারণে ঈদের দিনগুলো আমাদের কাছে আর অন্যান্য সাধারণ দিনের মতোই মনে হতে শুরু করেছে; আনন্দ যেন হারিয়ে যাচ্ছে জীবনের মাঝে। তবে, ঈদ আমাদের আত্মশুদ্ধি, মানবিক মূল্যবোধ এবং আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা অর্জন করার গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দেয়।
মো: রবিউল ইসলাম
পালি ও বুদ্ধিস্ট স্টাডিজ বিভাগ,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ঈদকে ঘিরে মিস করি শৈশবের সোনালি সময়গুলো :
পড়াশোনার সুবাদে বাড়ি থেকে দূরে অবস্থান করায় ঈদের আনন্দের সঙ্গে বাড়ি ফেরার আনন্দ মিলেমিশে একাকার হয়ে উচ্ছ্বাস-উন্মাদনা বেড়ে যায় কয়েকগুণ। পড়ালেখার কারনে কাছের বন্ধুদের সাথেও একটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়ে গেছিলো। একেক জন একেক শহরে থাকে। তবে ঈদে সবাই বাড়িতে আসলে এই বিষয়টা খুবই ভালো লাগে। এই ঈদে বন্ধুর সাথে সব দূরত্ব ঘুচিয়ে দিনগুলোকে বন্ধুত্বময় করে তোলার ব্যাপার টা সত্যি অসাধারণ ছিলো। তবে ঈদকে ঘিরে এখনকার এতসব উৎসব-উন্মাদনার ভীড়েও মিস করি শৈশবের সোনালি সময়গুলোকে।
ছোটবেলায় ঈদের দিন খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে ঠান্ডা পানিতে ঝাপিয়ে গোসল করা এবং নতুন জামা পড়ে কে কার আগে একে অন্যের নতুন জামা দেখব তা নিয়ে প্রতিযোগিতা চলতো। হরেক রকমের মজার মজার খাবারের ভোজনবিলাস তো ছিলই। দিনশেষে সালামির হিসাব-নিকাশের পর্ব সেরে পাড়া-মহল্লায় ঘুরে বেড়াতাম। কিন্তু সময়গুলো দ্রুত পাল্টে গিয়েছে । কেমন করে জানি বড় হয়ে গেলাম ! আর এখন, না চাইতেও যেন চিন্তার পাহাড় মাথায় চলে আসে। এর চেয়ে ঢের ভাল ছিল, আমার ছোটবেলার ঈদ। কোন চিন্তা ছিল না। জীবন যুদ্ধের মানে জানা ছিল না। আরো অনেক কিছুই তখন ছুঁয়ে যেত না। খুব মিস করি, সেদিনের দিনগুলো।
কায়েস শেখ
ইইই বিভাগ,
ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।
সম্প্রতীর বন্ধনে আবদ্ধ করে ঈদ:
ঈদ মানেই আনন্দ, উৎসব আর পরিবারের সঙ্গে কাটানো কিছু স্পেশাল মুহূর্ত। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ঈদের অভিজ্ঞতা একেকজনের জন্য একেক রকম। কেউ বাড়িতে গিয়ে পরিবারের সঙ্গে ঈদ করেছে, আবার কেউ হয়তো বিশেষ কারণে হলে বা মেসেই কাটিয়েছে উৎসবের দিনটি।
আমার ক্ষেত্রেও ঈদটা ছিল মিশ্র অনুভূতির। কয়েক মাস পর বাড়ি ফিরে পরিবারের সবার সঙ্গে ঈদের প্রস্তুতি নেওয়া, ঈদের দিন সকালে নতুন পোশাক পরে নামাজ পড়তে যাওয়া, আর তারপর আত্মীয়-স্বজনের বাসায় ঘুরে বেড়ানো, সব মিলিয়ে দারুণ সময় কেটেছে। তবে বন্ধুদের মিস করেছি, কারণ হলে থাকলে একসঙ্গে ইফতার, সেহরি, এমনকি ঈদের দিনেও সবার সঙ্গে আনন্দ ভাগ করে নেওয়ার একটা আলাদা মজা থাকে।
অন্যদিকে, যেসব বন্ধু নানা কারণে বাড়ি যেতে পারেনি, তারা নিজেদের মতো করে ঈদ উদযাপন করেছে। কেউ হয়তো বন্ধুদের নিয়ে ভালো খাবার রান্না করেছে, কেউবা শহরের কোনো ঘোরার জায়গায় গিয়ে দিন কাটিয়েছে। ঈদের দিনে বাসার মিষ্টির স্বাদ যেমন মনে পড়েছে, তেমনি বন্ধুদের আড্ডাটাও মিস করেছি।
সব মিলিয়ে, এবারের ঈদ অনেক কিছুর সংমিশ্রণ—আনন্দ, পরিবারের ভালোবাসা, বন্ধুদের মিস করা আর ভবিষ্যতের নতুন দিনের জন্য একটু বাড়তি শক্তি সঞ্চয়ের সময় ছিলো।
কাজী তাহসিন
বিবিএ বিভাগ, সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটি।
প্রকৃতির মাঝে ঈদের আনন্দ :
ঈদ-একটি শব্দ, কিন্তু যার ভেতর লুকিয়ে আছে অগণিত অনুভব, শত স্মৃতি আর অফুরান আনন্দের ঝরনা। মুসলিম উম্মাহর অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর। ঈদ শুধু ধর্মীয় আচার নয়, এটি সংস্কৃতি, এটি মানুষের সঙ্গে মানুষের বন্ধনের এক উৎসব।
ঈদ মানেই ঘরে ফেরার তাড়া। বছরের ব্যস্ততম এই সময়টায় দেশের হাজারো শিক্ষার্থী ছুটে যায় পরিবারের কাছে। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে বিষয়টা অন্যরকম। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুবাদে এবং নিজ জেলায় কলেজ হওয়ায় পরিবারের সাথেই থাকা হয় গ্রামে। তাই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে ঈদে ঘরে ফেরার যে অনুভূতি সেটা আমি পাই না। তবে গ্রামে থাকার সুবাদে আমার ঈদ কেটেছে গ্রামের সবুজ প্রকৃতিতে৷ প্রকৃতির মাঝে ঈদের যে আনন্দ তা কখনোই যান্ত্রিক শহরে পাওয়া যায় না। সেদিক থেকে দেখতে গেলে সবমিলিয়ে ভিন্নরকম এক ঈদ আমার জন্য।
রমজানের দীর্ঘ একমাস সংযম সাধনার পর ঈদুল ফিতর আসে খুশির বার্তা নিয়ে। পরিবার, বন্ধু, প্রতিবেশী সবাই একত্রিত হয়ে উদযাপন করি ভালোবাসা ও সহমর্মিতার এই দিন। ঈদের নামাজ, একে অপরকে কোলাকুলি, নতুন জামা, সেমাই-পায়েস আর মিষ্টি মুখ—সব মিলিয়ে ঈদ যেন ভালোবাসার এক চিরন্তন গল্প।
সোহান
ইতিহাস বিভাগ,
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়।
একুশে সংবাদ/বিএইচ
আপনার মতামত লিখুন :