দেশে সড়ক দুর্ঘটনার জন্য সরকারের দুর্নীতি ও ভুলনীতিকেই দায়ী করেছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি। সংগঠনের দাবি, স্বাধীনতার পর দাতা সংস্থার পরামর্শে একের পর এক সড়ক নির্মাণ ও উন্নয়নের নামে ব্যাপক লুটপাট, চাঁদাবাজি এবং নীতিগত ভুলের কারণে নৌ ও রেলপথ অবহেলিত হয়েছে, ফলে সড়ক দুর্ঘটনা ভয়াবহভাবে বেড়েছে।
মঙ্গলবার (২১ অক্টোবর) সকালে রাজধানীর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস-২০২৫ উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনের মহাসচিব মোঃ মোজাম্মেল হক চৌধুরী এসব অভিযোগ করেন।
তিনি বলেন, “স্বাধীনতার পূর্বে দেশে ৮০ শতাংশ মানুষ নৌ ও রেলপথে, আর মাত্র ২০ শতাংশ মানুষ সড়কপথে চলাচল করত। ফলে সড়কে দুর্ঘটনাও সীমিত ছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকে দাতা সংস্থার প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী একের পর এক নতুন সড়ক নির্মাণ, সড়ক সংস্কারের নামে লুটপাট এবং বহুমাত্রিক পরিবহন ব্যবস্থার পরিবর্তে সড়কের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করায় আজ দুর্ঘটনা ৮০ শতাংশে পৌঁছেছে।”
লিখিত বক্তব্যে মোজাম্মেল হক চৌধুরী আরও বলেন, “বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে পরিবহন খাতে সীমাহীন দুর্নীতি, ফিটনেসবিহীন যানবাহনের চলাচল, লাইসেন্সবিহীন ও অপ্রাপ্তবয়স্ক চালকের হাতে গাড়ির স্টিয়ারিং, মাদকাসক্ত চালক, সড়কের ত্রুটি, বেপরোয়া গতি—সব মিলিয়ে সড়ক পরিণত হয়েছে মৃত্যুফাঁদে।”
তিনি দাবি করেন, ২০১৪ সাল থেকে ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে মোট ৬৭ হাজার ৮৯০টি সড়ক দুর্ঘটনায় ১ লাখ ১৬ হাজার ৭২৬ জন নিহত এবং ১ লাখ ৬৫ হাজার ২১ জন আহত হয়েছেন। যাত্রী কল্যাণ সমিতির পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, হাসপাতালভিত্তিক প্রকৃত সংখ্যা আরও কয়েকগুণ বেশি।
মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, “ওবায়দুল কাদের দীর্ঘ একযুগ সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থেকেও বিশৃঙ্খলা ও প্রাণহানি ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছেন। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারও এখনো কার্যকর কোনো পরিবর্তন আনতে পারেনি।”
তিনি সতর্ক করে বলেন, “ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা নিবন্ধন দিয়ে রাস্তায় নামানোর উদ্যোগে নানা ত্রুটি ও অদক্ষতা রয়েছে। এই প্রক্রিয়া শুরু হলে এক বছরের মধ্যেই ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহর কার্যত অচল হয়ে পড়বে।”
সংবাদ সম্মেলনে তিনি ১২ দফা সুপারিশ উপস্থাপন করেন :
১. হারিয়ে যাওয়া নৌ ও রেলপথকে পুনরুজ্জীবিত করে সমন্বিত যাতায়াত নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা।
২. চাঁদাবাজি, অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধে পরিবহনখাতের পূর্ণ সংস্কার।
৩. ঢাকা-চট্টগ্রামসহ বিভাগীয় শহরে সরকারি উদ্যোগে ম্যাস ট্রানজিট (পাতাল মেট্রোরেল) ব্যবস্থা করা।
৪. প্রতিটি বিভাগীয় শহরে ডিজিটাল লেনদেনে ভিত্তিক দুটি বাস র্যাপিড ট্রানজিট (BRT) লেন চালু করা।
৫. জেলা থেকে উপজেলা পর্যন্ত মানসম্মত বাস নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা।
৬. মোটরসাইকেল ও ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা আমদানি ও বিপণন নিয়ন্ত্রণ করা।
৭. রাষ্ট্রীয় খরচে চালকদের উন্নত প্রশিক্ষণ প্রদান।
৮. ট্রাফিক বিভাগকে ডিজিটাল করা ও ট্রাফিক ট্রেনিং একাডেমি প্রতিষ্ঠা।
৯. সড়ক দুর্ঘটনার মামলা রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে গ্রহণ ও ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করা।
১০. পরিবহন খাতে যাত্রী প্রতিনিধিদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে অন্তর্ভুক্ত করা।
১১. পরিবহন খাতে সুশাসন ও কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা।
১২. পথচারী ও সাইক্লিস্টদের জন্য পৃথক লেন ও নিরাপদ ফুটপাত নির্মাণ করা।
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন সংগঠনের সভাপতি শরীফ রফিকুজ্জামান, বারভিটার সভাপতি আবদুল হক, এবং ড্রাইভার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান বাদল আহমেদ প্রমুখ।
একুশে সংবাদ/এ.জে