অপরুপ সৌন্দর্যের বিস্টেনিতে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য আর বৈচিত্র্যে ভরা চট্টগ্রাম। কিন্তু গত ১৫ বছরে এই শহরের প্রাকৃতিক ভারসাম্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নির্বিচারে পাহাড় কাটার কারণে। এর ফলে পরিবেশের ওপর পড়ছে ভয়াবহ বিরূপ প্রভাব, সৃষ্টি হচ্ছে নানা ধরনের প্রাকৃতিক ও মানবিক বিপর্যয়। নগরীর বায়েজিদ ও আকবর শাহ থানায় সবচেয়ে বেশি পাহাড় কাটার ঘটনা ঘটেছে। যেসব জায়গায় এক সময় ছিল উচু পাহাড় সেসব জায়গায় গড়ে উঠেছে বড় বড় দালান।
গত ১৫ বছরে শহরের ছোট-বড় অন্তত ৮৮টি পাহাড় টিলা কাটা হয়েছে নির্বিচারে। এসব পাহাড় কেটে নির্মাণ করা হয়েছে আবাসন, বহুতল বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, কলকারখানা ও বিভিন্ন অবকাঠামোসহ নানাবিধ স্থাপনা। এজন্য ক্ষেত্র বিশেষ সরকারি হস্তক্ষেপ দেখলেও বেশিরভাগ বিচারের আওতায় আসছে না। পরিবেশ অধিদপ্তরের মামলা হয় কিন্তু কার্যকর ফলাফল আসে না। নানা ফন্দি এঁটে এসব পাহাড় কাটা হয়। কখনও ব্যানার বা তেরপাল টানিয়ে। কখনও রাতের আঁধারে। কখনও চাষাবাদের নাম করে। কখনও দিনে আবার রাতে প্রকাশ্য দিবালোকে।
এসব পাহাড় কাটার পিছনে রয়েছে প্রতাপশালীদের লম্বা হাত। যাদের সরকারি উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের সাথে রয়েছে যোগসাজশ। রাজনৈতিক বলয়ের প্রতাপ আর সরকারি যোগসাজশে কাটা হয় পাহাড়। মূল হোতারা আড়ালে থেকে নীরবে করে থাকেন। এসব কর্মকাণ্ডে প্রশাসনও অনেকটা লোক দেখানো অভিযান পরিচালনা করে। মাঝে মধ্যে চশমা পরিধান করার মতো আচরণ করেন। মাঝে মাঝে গুটিকয়েক অভিযানে চুনোপুঁটিরা জরিমানা গুণলেও নেপথ্যের খলনায়করা অধরাই থাকেন। তবে বর্তমান প্রশাসন পাহাড় কাটা নিয়ে বেশ তৎপর।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন, বিভাগীয় কমিশনার উদ্যোগ নিয়ে পাহাড় রক্ষার জন্য পুরোদমে কাজ করছেন। এক্ষেত্রে বিভিন্ন পরিবেশ আন্দোলনের কর্মীদের সাথে নিয়ে অংশীজন কমিটি করেছেন। এছাড়া চট্টগ্রাম শহরকে চারটি জোনে ভাগ করে ভূমি কার্যালয়ের অধীনে কাজ ভাগ করে দিয়েছেন যাতে এসব পাহাড় রক্ষা পায়, প্রভাবশালীরা কেউ কাটতে না পারে। গত এক বছরে আগের তুলনায় পাহাড় কাটা কমেছে বলেও জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা ।
দুই বছর আগের এক গবেষণায় দেখা গেছে, নগীর পাহাড়গুলোর উচ্চতা সর্বনিম্ন ১৫ থেকে সর্বোচ্চ ৪৫ মিটার পর্যন্ত। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৬০ সালে প্রথম চট্টগ্রামে আবাসিক এলাকা করার জন্য জঙ্গল কেটে পাহাড় পরিষ্কার করে। ১৯৫০ সালে নগরের ষোলশহর, নাসিরাবাদ, পাহাড়তলী ও ফৌজদারহাট এলাকায় শিল্প এলাকা স্থাপনের জন্য কিছু পাহাড় কাটা হয়। ১৯৬০ সাল থেকে সরকারি বাংলো তৈরির পাশাপাশি পাহাড় কিনে বিলাসবহুল ভবন নির্মাণ শুরু হয়। ১৯৭৬ সাল থেকে পাহাড় কাটা ব্যাপকতা পায়। ১৯৮০ সাল থেকে নগরের বিভিন্ন স্থানে পাহাড় কেটে আবাসিক এলাকা নির্মাণ ও শুরু হয়। একসময় এ নগরীতে ছোট বড় প্রায় ২০০টি পাহাড় ছিল। ইতোমধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গেছে ১২০টি পাহাড়।
১৯৭৬ সালে চট্টগ্রাম নগরীর বায়েজিদ, খুলশী, পাঁচলাইশ, কোতোয়ালী ও পাহাড়তলী এলাকায় মোট পাহাড় ছিল ৩২.৩৭ বর্গকিলোমিটার। ২০০৮ সালে সেটি কমে দাঁড়িয়েছে ১৪.২ বর্গকিলোমিটারে। বিগত ৩২ বছরে ১৮.৩৪৪ বর্গকিলোমিটার পাহাড় নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হয়েছে যা মোট পাহাড়ের প্রায় ৫৭ শতাংশ। সর্বশেষ বিদ্যমান পাহাড়গুলোও নির্বিচারে কাটা হচ্ছে। চট্টগ্রাম শহরের জিইসি মোড় সংলগ্ন গরিবুল্লাহশাহ হাউজিং এর মুখে, ষোলশহর, ফয়েজ লেক, শেরশাহ, আরেফিন নগর, আকবরশাহ, ফিরোজশাহ, জালালাবাদ, কুলগাঁও এবং উপজেলার মধ্যে সীতাকুন্ড, বাঁশখালীর চাম্বল ইউনিয়ন, সাতকানিয়া ও লোহাগাড়ার বিভিন্ন স্থানে বিচ্ছিন্নভাবে কাটা হয়েছে পাহাড়।
নির্বিচারে পাহাড় কাটার ফলে জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে, বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল নষ্ট হচ্ছে এবং প্রাকৃতিক ইকোসিস্টেম ভেঙ্গে পড়ছে। পাহাড় কেটে ফেলার ফলে বৃষ্টির পানি দ্রুত নিচে নেমে আসে, যা জলাবদ্ধতা এবং বন্যার প্রকোপ বাড়ায়, বিশেষ করে শহরাঞ্চলে। পাহাড়ের গাছপালা হারিয়ে যাচ্ছে। অনেক পাহাড়ি জীববৈচিত্র্য হারিয়ে গেছে এবং অনেক প্রজাতি বিপন্নপ্রায় অবস্থায় টিকে আছে। পাহাড়ি অঞ্চলের মাটি ক্ষয় বেড়েছে ও মাটির উর্বরতা হ্রাস পাচ্ছে এবং অল্প বৃষ্টিপাতে ভূমি ধসের মত দুর্ঘটনা ঘটছে। ভূমিকম্পের মত ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘনঘন দেখা দিচ্ছে যা অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়।
জানা গেছে, পাহাড় কাটার দায়ে প্রতি বছর পরিবেশ অধিদপ্তর দশ থেকে পনেরোটি মামলা করে থাকে। গত ১৫ বছরে এরকম মামলা হয়েছে শতাধিক। আবার অধিদপ্তরের অগোচরে রয়ে যায় অনেক পাহাড় কাটার ঘটনা। বায়েজিদ ও আকবরশাহ এলাকায় বেশি পাহাড় কাটার ঘটনা ঘটছে। প্রায় ৮০ শতাংশ মামলা হয়েছে এ দুটি এলাকায়। কিন্তু অধিকাংশ মামলা কার্যকর ফলাফল বয়ে আনছে না। পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রামের এক কর্মকর্তা বলেন, পাহাড় কাটার খবর পেলেই অভিযান চালানো হয়। প্রতি মাসেই মামলা করা হয়। পাহাড় কাটার সঙ্গে বিভিন্ন পেশার লোকেরা জড়িত। এটি বন্ধ করতে সমন্বিত উদ্যোগ দরকার বলে মনে করেন তিনি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, চট্টগ্রামে পাহাড় কাটার পেছনে মূলত কয়েকটি পক্ষ জড়িত, যাদের যোগসাজশে এই ধ্বংসযজ্ঞ চলছে। সবচেয়ে বেশি পাহাড় কাটার ঘটনা ঘটিয়েছে ভূমিদস্যু এবং আবাসন ব্যবসায়ীরা। তারা কম দামে পাহাড় বা টিলার জমি কিনে তা কেটে প্লট তৈরি করে চড়া দামে বিক্রি করে। অবৈধভাবে গড়ে ওঠা এসব আবাসন প্রকল্পের পেছনে শক্তিশালী সিন্ডিকেট কাজ করে। গত পনেরো বছর আওয়ামী লীগের আমলে রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় পাহাড় কাটার ঘটনা ঘটেছে। স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা ভূমিদস্যুদের সঙ্গে আঁতাত করে পাহাড় কাটার কাজ নির্বিঘ্নে চালিয়ে যায়। চট্টগ্রামে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে শুরু থেকেই সোচ্চার ভূমিকা পালন করছে। তারা নিয়মিতভাবে বিভিন্ন প্রতিবাদ কর্মসূচি, মানববন্ধন, সেমিনার এবং আলোচনা সভার আয়োজন করে জনসচেতনতা বৃদ্ধির চেষ্টা করছে। অনেক সংগঠন পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে রিট পিটিশন দায়ের করেছে এবং আইনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো পাহাড় কাটার ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে বিভিন্ন প্রতিবেদন ও গবেষণা প্রকাশ করে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির বেলার এক কর্মকর্তা বলেন, চট্টগ্রামে নির্বিচারে পাহাড় কাটা একটি গুরুতর সমস্যা যা পরিবেশ ও মানবজাতির জন্য মারাত্মক হুমকি। এই সমস্যা মোকাবেলায় সরকার, প্রশাসন, পরিবেশবাদী সংগঠন এবং সাধারণ জনগণ সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। পাহাড় রক্ষা কেবল পরিবেশের বিষয় নয়, এটি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ ও বাসযোগ্য নগরী নিশ্চিত করার প্রশ্ন। অবৈধ পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ, পরিবেশ সচেতনতা বৃদ্ধি এবং বিকল্প উন্নয়নের পথ খুঁজে বের করার মাধ্যমেই কেবল এই ধ্বংসযজ্ঞ থামানো সম্ভব, এবং চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও ভারসাম্য ফিরিয়ে আনা সম্ভব।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক শ. ম. বখতিয়ার বলেন, পাহাড় কাটা নিয়ে বর্তমান প্রশসান খুব বেশি তৎপর। পাহাড় কাটা বন্ধে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন আমাদের নিয়ে কমিটি গঠন করেছেন। বিভিন্নভাবে মনিটরিং করা হচ্ছে। আমাদের পক্ষ থেকে আমরা প্রতিবেদন দিচ্ছি। নগরের চারটি জোনে ভাগ করে ভূমি কার্যালয় কাজ দেয়া হয়েছে। আর কিছু পাহাড় বাস্তবে আছে কিন্তু খতিয়ানে দেখাচ্ছে জমি বা সমতল। সেটিও পরিবর্তন করার কাজ চলছে। যেসব পাহাড় কেটে ফেছেলে সেগুলো আর ফেরত আনা যাবে না কিন্তু বিদ্যমান আছে সেগুলো রক্ষার দায়িত্ব আমাদের সবার।
একুশে সংবাদ/চ.প্র/এ.জে



একুশে সংবাদের সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

