মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলার ঐতিহ্যবাহী ধলেশ্বরী নদী আজ প্রাণশূন্য। ভরা বর্ষার মৌসুমেও যেখানে নদীর বুক ভরে প্রবল স্রোতের পানি থাকার কথা, সেখানে এখন পুরো নদী এলাকা ঘন কচুরিপানায় আবৃত। নৌকা, ট্রলার ও লঞ্চসহ সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। দূর থেকে তাকালে মনে হয়, এটি নদী নয়, বিস্তৃত সবুজ মাঠ। ফলে নদীর উপর নির্ভরশীল স্থানীয়দের জীবিকা ও জলপথের যোগাযোগ ব্যবস্থা থমকে গেছে।
প্রায় ১৬৮ কিলোমিটার দীর্ঘ ধলেশ্বরী নদীর উৎপত্তি টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ীর ভাটিতে যমুনা নদী থেকে। এটি মানিকগঞ্জের ঘিওর, সাটুরিয়া ও সিংগাইর হয়ে বংশাই নদীতে মিশেছে। একসময় এই নদী ছিল দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল থেকে ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ নৌ-সংযোগ মাধ্যম। সিংগাইরের বায়রা-নয়াবাড়ী থেকে বংশাই নদী পর্যন্ত প্রায় ৩০ কিলোমিটার অংশে চলত তিনতলা লঞ্চ ও স্টিমার। উত্তাল স্রোতের নদী ছিল ইলিশ, বোয়াল, পাবদা মাছের ভান্ডার; দেখা যেত শুশুক ও কুমিরও।
কিন্তু কয়েক দশকে ধলেশ্বরী নদী হারিয়েছে প্রাণ। দুই তীরে গড়ে উঠেছে কারখানা, ইটভাটা ও বসতবাড়ি। শিল্পবর্জ্য সরাসরি নদীতে ফেলা হচ্ছে। প্রভাবশালী মহলের দখল ও ভরাটে নদীর শাখানদী বিলীন হচ্ছে। ফলে নদী এখন কচুরিপানার কারাগারে বন্দী।
২০০৫ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে কাংশা থেকে ফোর্ডনগর পর্যন্ত প্রায় ২৫ কিলোমিটার খনন করা হয়েছিল, যা অর্ধকোটি টাকার বেশি ব্যয়ে করা হয়েছিল। তবে স্থায়ী সমাধান হয়নি। বর্তমানে ভরা বর্ষাতেও নদীর বুক কচুরিপানায় ভরাট। কৃষকরা ফসল নৌকায় পরিবহন করতে পারছেন না, জেলেরা জাল ফেলতে পারছেন না, শ্রমিকরা কাজ হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন।
স্থানীয় সচেতন নাগরিক মুহাম্মদ কুদ্দুসুর রহমান বলেন, “আজ ভরা বর্ষাতেও ধলেশ্বরী মৃত। কচুরিপানা নদীর বুক ঢেকে দিয়েছে, যোগাযোগ ব্যবস্থা অচল। নদী বাঁচানো না গেলে এই অঞ্চলের জীবনও বাঁচবে না।”
খাসের চর গ্রামের প্রবীণ আব্দুর রহমান অভিযোগ করেন, “আমরা বহুবার প্রশাসনকে জানিয়েছি, কিন্তু কার্যকর পদক্ষেপ নেই। আগে ধলেশ্বরী ছিল জীবনের অংশ, এখন দুর্ভোগের প্রতীক।”
স্থানীয় জেলে সিদ্দিক মিয়া জানান, “তিন দিন জাল ফেললেও এক কেজি মাছও মেলা যায় না। নৌকা চালালে কচুরিপানার ফাঁদে পড়তে হয়। পরিবার চালানোই কষ্টকর।”
চর দুর্গাপুর এলাকার বাসিন্দা আমিনুর রহমান বলেন, “শুধু ২-৩ কিলোমিটার খনন করা হলে আবার নৌযান চলাচল শুরু হবে। জরুরি ভিত্তিতে খনন করা প্রয়োজন।”
মানিকগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মুহাম্মদ আক্তারুজ্জামান বলেন, “বর্ষায় কচুরিপানা স্বাভাবিকভাবেই অনেক সময় সরে যায়। তবে অপসারণের জন্য আলাদা বরাদ্দ নেই। আগামীতে নদী খননের পরিকল্পনা রয়েছে।”
একুশে সংবাদ/মা.প্র/এ.জে