বাংলাদেশের পোশাক খাতের লাখো নারী শ্রমিকের জন্য প্রজনন স্বাস্থ্যসেবায় এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে চালু হলো ‘ডিজিটাল মনিটরিং টুল’ (ডিএমটি)।
বুধবার (৩০ জুলাই) ঢাকার সাভারে একটি পোশাক কারখানায় এই টুলের পরীক্ষামূলক উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় নতুন এই উদ্যোগ, যার লক্ষ্য স্বাস্থ্যসেবাকে স্মার্ট, স্কেলযোগ্য ও জবাবদিহিমূলক করে তোলা। সকালে উপজেলার গেন্ডা এলাকায় পাকিজা নিট কম্পোজিট কারখানায় এ উপলক্ষে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়।
জাতীয় পর্যায়ে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর (ডিজিএফপি), জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) এবং বেসরকারি খাতের অংশীদারদের যৌথ সহযোগিতায় প্রথম পর্যায়ে ছয়টি কারখানার ২২ হাজারেরও বেশি নারী সরাসরি উপকৃত হবেন। তবে প্রাথমিকভাবে ৭ হাজার ৬০০ জন নারীকে পরিবার পরিকল্পনা সেবা দেওয়ার মাধ্যমে কার্যক্রম শুরু হচ্ছে।
ডিজিটাল মনিটরিং টুলটি মূলত একটি দ্বৈত-প্ল্যাটফর্ম সিস্টেম, যার মাধ্যমে কারখানার স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে রিয়েল-টাইমে তথ্য সংগ্রহ, গর্ভনিরোধক সামগ্রীর মজুত ও বিতরণ ট্র্যাকিং এবং কর্মক্ষমতা পর্যালোচনা করা যাবে।
কারখানার এক নারী শ্রমিকের হাতে জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর একটি প্যাকেট তুলে দিয়ে সেটি টুলে হালনাগাদ করার দৃশ্যই যেন এই প্রযুক্তির বাস্তব রূপ।
সংশ্লিষ্টরা জানান, শ্রমিকের আইডি নম্বর দিয়ে নিবন্ধনের পর জানা যাবে কখন তার জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী শেষ হবে, পরবর্তী জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রি গ্রহণের তারিখও অ্যাপেই জানিয়ে দেওয়া হবে।
ইউএনএফপিএ-এর প্রতিনিধি ক্যাথরিন ব্রিন কামকং উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বলেন, “এই টুলটি শুধু প্রযুক্তি নয়, এটি নারীদের মর্যাদা ও পেশাদারিত্ব নিশ্চিত করার হাতিয়ার। যারা অর্থনীতির চালিকাশক্তি, তাদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা আমাদের অগ্রাধিকার হওয়া উচিত।”
উল্লেখযোগ্য, বাংলাদেশের গার্মেন্ট খাতে প্রায় ৪০ লাখ কর্মী রয়েছেন, যাদের ৬০ শতাংশের বেশি নারী। কিন্তু যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা এখনো অনেকের নাগালের বাইরে।
ইউএনএফপিএ-এর সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, পরিবার পরিকল্পনায় বিনিয়োগ ২০% পর্যন্ত উৎপাদনশীলতা বাড়ায় এবং ২৬% পর্যন্ত কর্মী অনুপস্থিতি কমায়। একেকটি কারখানা বছরে গড়ে ১ লাখ ৬০ হাজার ডলার পর্যন্ত সাশ্রয় করতে পারে এই সেবার মাধ্যমে।
গত ৯ বছরে মাত্র ৮ লাখ ৪ হাজার নারী কর্মী গর্ভনিরোধক গ্রহণ করেছেন, যা শ্রমিক মোট সংখ্যার তুলনায় অতি সামান্য। এই ডিজিটাল টুল সেই ব্যবধান কমিয়ে আনার বড় সম্ভাবনা নিয়ে এসেছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
পাকিজা নিট কম্পোজিট লিমিটেড-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাকিবুল ইসলাম খান বলেন, “আমরা সবসময় কর্মীদের কল্যাণকে গুরুত্ব দিই। সুস্থ কর্মী মানে শক্তিশালী উৎপাদনশীলতা, আর সে কারণেই এই উদ্যোগে যুক্ত হওয়া।”
এই উদ্যোগটি ডিজিএফপি এবং ইউএনএফপিএ-এর একটি বৃহত্তর স্বাস্থ্য কৌশলের অংশ, যেখানে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে জরায়ুমুখের ক্যান্সার স্ক্রিনিং এবং লিঙ্গ-ভিত্তিক সহিংসতার তাত্ক্ষণিক সেবাও।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. আশরাফি আহমদ এনডিসি বলেন, “এই প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রমাণ হবে, সরকার জনগণের কল্যাণে প্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে চায়।”
ডিএমটি নির্মাণে প্রযুক্তিগত সহায়তা দিয়েছে টোগুমোগু প্রাইভেট লিমিটেড ও জেপাইগো। এই টুল কাগজ নির্ভর সিস্টেমকে প্রতিস্থাপন করবে, যাতে সাপ্লাই চেইনে কোনো ব্যাঘাত না ঘটে এবং কর্মীরা নিজের প্রয়োজন অনুযায়ী স্বাস্থ্যসেবা পেতে পারেন।
আগামী ছয় মাস এই টুলের পাইলট বাস্তবায়ন চলবে ছয়টি কারখানায়। পরে ডেটা ইন্টিগ্রেশন, পারফরম্যান্স রিপোর্টিং এবং জাতীয় পর্যায়ে সম্প্রসারণের লক্ষ্যে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ব্যবহারকারীদের প্রতিক্রিয়ার ভিত্তিতে টুলটি নিয়মিত পরিমার্জন করা হবে বলেও জানানো হয়েছে।
এই প্রযুক্তির সফল বাস্তবায়ন হলে, দেশের গার্মেন্ট খাতে স্বাস্থ্যসেবার নতুন এক দিগন্ত উন্মোচিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে সংশ্লিষ্ট মহলে।
একুশে সংবাদ/সা.প্র/এ.জে