কিশোরগঞ্জের ইটনা উপজেলার জয়সিদ্ধি ইউনিয়নের আলগাপাড়া গ্রামের মানুষজন শোকাচ্ছন্ন। তারা হারিয়েছে তাদের একজন নিঃস্বার্থ সেবককে। তিন হাজারের বেশি মানুষের শেষ বিদায়ের সাথী, জীবনের অর্ধশত বছর যিনি ব্যয় করেছেন শুধু অন্যের জন্য—সেই মো. মনু মিয়া (৬৭) আর নেই। শনিবার (২৮ জুন) সকাল ১০টায় নিজ বাড়িতে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।
তার মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছেন জয়সিদ্ধি ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান মো. বাহাউদ্দিন ঠাকুর।
‘শেষ ঠিকানার কারিগর’ নামে খ্যাত মনু মিয়ার জীবনের গল্প এক অনন্য মানবিক উপাখ্যান। ১৯৭০-এর দশক থেকে তিনি কোনো পারিশ্রমিক ছাড়াই মানুষের কবর খুঁড়ে আসছিলেন। সমাজের সবচেয়ে শোকাবহ মুহূর্তে নিঃস্বার্থভাবে পাশে দাঁড়ানো এই মানুষটির সেবার পরিধি ছিল অসীম। তিনি ছিলেন নিঃস্বার্থ মানবিকতার এক উজ্জ্বল উদাহরণ।
প্রায় ৪৯ বছর ধরে তিনি কবর খনন করেছেন কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। এ সময়ে তিনি তিন হাজারেরও বেশি মৃত ব্যক্তিকে ‘শেষ ঠিকানায়’ পৌঁছে দিতে সহায়তা করেছেন। কখনো কারও কাছ থেকে কোনো অর্থ বা পুরস্কার গ্রহণ করেননি। বরং নিজের দোকান বিক্রি করে একটি ঘোড়া কিনেছিলেন, যেন মৃতের খবর পেলে দ্রুত সেখানে পৌঁছাতে পারেন।
সেই প্রিয় ঘোড়াই হয়ে উঠেছিল তার জীবনের অবিচ্ছেদ্য সঙ্গী। মৃত্যুসংবাদ পেলেই ঘোড়ায় চড়ে ছুটে যেতেন মনু মিয়া। কিন্তু সম্প্রতি অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি থাকাকালীন দুর্বৃত্তরা তার বহু বছরের সাথী সেই ঘোড়াটিকে হত্যা করে। এই নির্মম ঘটনায় তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন।
ঢাকার আইনজীবী ও মনু মিয়ার এলাকার সন্তান অ্যাডভোকেট শেখ মো. রোকন রেজা জানান, হাসপাতালে মনু মিয়ার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন তিনি। অনেকেই তখন তাকে নতুন ঘোড়া কিনে দিতে চাইলেও মনু মিয়া বিনয়ের সঙ্গে তা প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি বলেছিলেন— “আমি এই কাজ করি আল্লাহকে খুশি করার জন্য। মানুষের কাছ থেকে কিছু নিতে চাই না।”
স্থানীয় জনপ্রতিনিধি মো. বাহাউদ্দিন ঠাকুর বলেন, “ঘোড়ার মৃত্যুর পর থেকেই মনু মিয়ার শরীর ভেঙে পড়ে। চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফিরলেও আর আগের মতো উঠে দাঁড়াতে পারেননি।”
মনু মিয়ার মৃত্যুতে পুরো এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে। এলাকাবাসীর ভাষায়, তিনি শুধু একজন কবর খননকারী ছিলেন না—তিনি ছিলেন মানবিকতার প্রতীক। ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবার শেষ বিদায়ে তিনি ছিলেন নির্ভরতার নাম। মৃত্যুর পরও মানুষের দোয়া ও ভালোবাসায় চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন তিনি।
একুশে সংবাদ/কি.প্র/এ.জে