ময়মনসিংহের ভালুকাকে একটি পরিচ্ছন্ন, শৃঙ্খলাবদ্ধ, মাদক ও দূষণমুক্ত আধুনিক উপজেলায় রূপান্তরিত করতে এক নিরলস প্রচেষ্টায় নেমেছেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) হাসান আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ। প্রশাসনের নেতৃত্বে শুরু হয়েছে দৃশ্যমান ও বাস্তবমুখী কর্মসূচি, যার প্রাথমিক ধাপ হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে ভালুকা বাসস্ট্যান্ড এবং শহরের গুরুত্বপূর্ণ হাইওয়ে-সংলগ্ন এলাকাগুলো।
বাসস্ট্যান্ড পুনর্গঠন : সময়ের দাবি, বাস্তবায়নের সংকল্প
ভালুকার বাসস্ট্যান্ডকে শৃঙ্খলাবদ্ধ ও পরিচ্ছন্ন করতে গিয়ে ইউএনওর নেতৃত্বে প্রশাসনকে বারবার উচ্ছেদ অভিযান চালাতে হয়েছে। অসাধু কিছু ব্যবসায়ীর বাধা ও প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা উন্নয়ন কার্যক্রমে বারবার বাধা সৃষ্টি করছে।
‘আমরা গত ২ মাস আগে যাদের উচ্ছেদ করেছি, তাদের প্রতেকের জন্য আমাদের সুন্দর পরিকল্পনা আছে। যেমন ফলের মার্কেট করে দিয়েছি, সবাই ওখানে বসলে একজন ক্রেতারও তো বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু তারা সেটা না করে মার্কেটকে গুদাম বানিয়ে বাইরে দোকান করছে, কেউ কেউ প্রভাব বিস্তারের অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছেন। ৫ বার আমাকে উচ্ছেদ করতে হয়েছে। এখন এরাই আবার বাইরে থেকে লোক এনে নতুন দোকান বসানোর পাঁয়তারা করছেন।’
—হাসান আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ, ইউএনও, ভালুকা
তিনি স্পষ্ট করে বলেন, এদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত যা নেবার আমরা নিয়ে নিয়েছি, শুধু ইমপ্লিমেন্ট করব। সময় কথা বলবে।
‘সময়ের সঙ্গে বাস্তবতা প্রমাণ করবে কারা ভালুকার উন্নয়ন চায়, আর কারা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে।’
চায়ের দোকান নিয়ে আধুনিক পরিকল্পনা : পরিচ্ছন্নতার সঙ্গে অর্থনৈতিক স্বপ্নও জড়িত। ভালুকা শহরে থাকা ২৭টি চায়ের দোকানকে আধুনিক রূপ দিতে চেয়েছে উপজেলা প্রশাসন। শহরের সৌন্দর্য ও শৃঙ্খলার স্বার্থে ৭-৮টি নির্দিষ্ট জায়গায় দৃষ্টিনন্দন টি-স্টল নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়, যা হবে যানজটমুক্ত ও স্বাস্থ্যসম্মত।
এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ইউএনও হাসান আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ যার ছবি এবং প্রতিটি দোকানের নাম ‘Uno Bhaluka’ ফেসবুক অ্যাকাউন্টে প্রকাশ করেছেন, যাতে আগেভাগেই ভালুকাবাসী দেখতে পারেন প্রশাসনের স্বপ্ন কেমন হতে যাচ্ছে।
‘চায়ের দোকান ছিল আমাদের ২৭টি, তারা প্রত্যেকেই একই ধরণের চা বিক্রি করে, কোনো ভ্যারিয়েশন নেই, সব শ্রেণির ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে পারে না। আর মাথার উপরে নোংরা, ছেড়া পলিথিন, বিচ্ছিরি পরিবেশ। ওরা তো কষ্ট করেই, ক্রেতারাও সন্তুষ্ট হবার কোনো কারণ নেই। আমাদের ইচ্ছা ছিল যেখানে বসালে জ্যাম হবে না, তেমন ভিন্ন ভিন্ন ৭-৮টি স্পটে তাদের জন্য অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন কিছু টি স্টল অনেকটা ফুড পার্কের মতো করে দিব। কিন্তু যখনই স্পটগুলো বাছাই করতে গেলাম পেছনের গুটিকয়েক দোকানদার বাঁধ সাধলেন। বললেন, এতে তাদের ব্যবসার ক্ষতি হবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো আগে এই জায়গাগুলোতে দোকানপাট ছিল এবং এখনোও আবার তারা করতে দিয়েছে, যার বেশির ভাগই টাকার বিনিময়ে। প্রতিদিন শেষে তাদের টাকা দিতে হয় এবং সেটা ৫০-২০০ পর্যন্ত! পৌরসভা বা উপজেলা প্রশাসন বসালে এই ইনকামটা বন্ধ হয়ে যেত। আমি বিনা খরচে তাদেরকে ভালো একটা ব্যবস্থা করে দিতে চেয়েছিলাম। তখন অল্প কিছু লোক আবদার করে বসে, এতে তাদের ব্যবসার ক্ষতি হবে বলে। আমিও জোর করিনি। কারণ আমি জানতাম তারা দোকান বসাবেই এবং হয়েছেও তাই। যারা আপত্তি বেশি করেছে তাদের দোকানের সামনে ২-৩টি করে চায়ের দোকান এখন। যা হোক এটা নিয়েও প্ল্যান আছে, সময় হলে সবাই দেখবেন সেটা।’
—ইউএনও
একটি বাসস্ট্যান্ডেই আটকে নেই স্বপ্ন : সার্বিক উন্নয়ন পরিকল্পনার অংশ এটি।
ভালুকার উন্নয়নকে শুধু একটি বাসস্ট্যান্ডে সীমাবদ্ধ না রেখে, রাস্তাঘাট, বাজার ব্যবস্থাপনা, পরিবেশ সংরক্ষণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, চিকিৎসা, লিটার ম্যানেজমেন্ট, ফিশারি উন্নয়ন এবং মাদক নিয়ন্ত্রণসহ বহুমাত্রিক বিষয়ে সমান গুরুত্ব দিচ্ছেন ইউএনও।
‘একটা বাসস্ট্যান্ডের জন্য এত সময় দিতে হচ্ছে যে ভাবছি—আমি বাকি কাজগুলো কখন করব? অনেক বোঝানো হয়েছে, বল প্রয়োগও করা হয়েছে (যদিও যথেষ্ট না) এরপর আর কোথাও নমনীয়ভাবে কাউকে বোঝানো হবে না। আইন মানতে বাধ্য করা হবে। যেহেতু কেউ কর্মহীন হচ্ছেন না, তাই এ নিয়ে কোনো আপস নয়।’
—ইউএনও
ভালুকাবাসীর প্রতি ইউএনওর উদাত্ত আহ্বান উন্নয়নের এ যাত্রায় স্থানীয় জনসাধারণের সক্রিয় সহযোগিতা চেয়ে ইউএনও বলেন, ‘আমি একা কিছুই করতে পারব না। ভালুকাকে বদলে দিতে হলে সকলকেই এগিয়ে আসতে হবে। আমি বিশ্বাস করি—ভালুকাবাসী আগামীর প্রজন্মের জন্য একটি পরিচ্ছন্ন ও সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়তে প্রশাসনের পাশে থাকবে।’
তিনি আশাবাদী হয়ে আরও যোগ করেন— ‘আমি আপনাদের সহযোগিতা আরও সম্প্রসারিতভাবে পাব বলে বিশ্বাস করি। আমার খুব স্বপ্ন—যে কিছু দিন ভালুকায় আছি, সকলের সহযোগিতায় একটি সুন্দর, পরিচ্ছন্ন, মাদকমুক্ত, দূষণমুক্ত ভালুকা গড়ার জন্য দিনরাত কাজ করব।’
ভালুকাকে সত্যিকারের একটি উন্নত, সুশৃঙ্খল ও পরিচ্ছন্ন উপজেলা হিসেবে গড়তে ইউএনও হাসান আব্দুল্লাহ আল মাহমুদের পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে সাহসী ও সময়োপযোগী। যদিও কিছু বাধা রয়েছে, তবে প্রশাসনের অদম্য মনোভাব ও জনসম্পৃক্ততা থাকলে এই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিতে খুব বেশি সময় লাগবে না।
‘পরিবর্তন সময় নেয়, কিন্তু সৎ পরিকল্পনা আর জনসম্পৃক্ততা থাকলে কোনো কিছুই অসম্ভব নয়।’
একুশে সংবাদ/ম.প্র/এ.জে