তখনো ভোরের আলো ঠিক মতো ফোটেনি। মসজিদে ফজরের নামাজ শেষে একে একে বেরিয়ে পড়ছেন মুসল্লিরা। কেউ প্রাতঃভ্রমণ করছেন, কেউবা বাড়ির পানে চলেছেন ধীর পদক্ষেপে। কেউবা ছুটেছেন নিজ নিজ কাজে। তাদেরই একজন কুরআনের হাফেজ মো. ইব্রাহিম। তিনিও ছুটেছেন নিজের গন্তব্যে।
তাদের মধ্যে কেউ কেউ চলেছেন খবরের কাগজের স্টলের দিকে। গরম গরম তাজা খবর পেতে। এই তাজা খবর সরবরাহকারী ইব্রাহিম চঞ্চল গতিতে ততক্ষণে খবরের কাগজের গাইট নিয়ে হাজির হয়েছেন বিক্রি স্থলে। এখন হবে খবরের বিকিকিনি। নরসিংদীর পলাশ উপজেলার ঘোড়াশাল ফেরিঘাটের খুব সকালের নিয়মিত দৃশ্য ছিল এটি।
স্থানীয়রা জানান, একটানা প্রায় ৪২ বছর ধরে পত্রিকা বিক্রি করে আসছেন ইব্রাহিম। সময় বদলেছে, সমাজ বদলেছে, মানুষের পাঠাভ্যাস বদলেছে। কিন্তু বদলায়নি ইব্রাহিমের দায়িত্ববোধ, নিষ্ঠা, কঠোর পরিশ্রম আর পত্রিকা বিক্রির সংগ্রাম। হ্যাঁ, আধুনিক ডিজিটাল যুগে পত্রিকা বিক্রি এক প্রকার সংগ্রামই বটে!
ইব্রাহিম কেবল একজন পত্রিকা বিক্রেতাই নন, তিনি একজন কুরআনের হাফেজও। শৈশবে গ্রামের মাদরাসায় কুরআন হিফজ করে শুরু হয়েছিল জীবন। পরিবারে অভাব-অনটনের হাত থেকে মুক্তির পথ খুঁজতে গিয়ে হাতে তুলে নেন পত্রিকার ব্যাগ। সেই থেকেই শুরু হয় জীবন যুদ্ধের নতুন অধ্যায়।
একসময় হাজার কপিরও বেশি পত্রিকা বিক্রি হতো দিনে। দোকানদার, চাকরিজীবী, অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তি কিংবা সাধারণ পাঠক- সবাই অপেক্ষা করতেন খবরের কাগজের জন্য। ইব্রাহিমের টেবিল হয়ে উঠত বাজারের তথ্য কেন্দ্র।
‘আগে পত্রিকা মানেই ছিল মানুষের চোখের আলো, কানের শব্দ। সবাই জানার জন্য মুখিয়ে থাকত। এখন মোবাইলে চোখ, খবর পড়ে না কেউ।’ বলছিলেন ইব্রাহিম।
আজকের দিনে যেখানে কাগজের পত্রিকার বাজার ধীরে ধীরে সংকুচিত হয়ে আসছে, সেখানে ইব্রাহিম এখনও সেই পুরোনো পথেই হেঁটে চলেছেন দৃঢ় চিত্তে।
তিনি বলেন, ‘আগে দৈনিক হাজার কপি বিক্রি করতাম, এখন ২০০ কপিও বিক্রি হয় না। তবুও কাজটা ছাড়িনি। এটা আমার রিজিক, এতে লজ্জা কিসের? আমি গর্ব করি এই কাজ নিয়ে। সারাদিন পত্রিকা বিক্রি শেষে সময় দেই কোরআন তিলাওয়াতে, নামাজে ও ধর্মীয় শিক্ষায়। জীবিকার জন্য ছোট কাজ বলে কিছু নেই। যদি তাতে থাকে ইমান, যদি থাকে সম্মান আর দায়িত্ববোধ, তাহলেই সেই কাজ হয়ে ওঠে ইবাদতের মতো।’
স্থানীয় বাসিন্দা কামাল হোসেন বলেন, ‘তিনি একজন আলোকিত মানুষ, যিনি জীবিকার প্রয়োজনে হাতের কাজ বদলালেও হৃদয়ের ধর্মবিশ্বাস বদলাননি। তার জীবন যেন এক জীবন্ত দৃষ্টান্ত- কীভাবে দ্বীন ও দুনিয়ার মাঝে ভারসাম্য রাখা যায়।’ তিনি আমার একজন প্রিয় মানুষও বটে।
বাজারের দোকানদার থেকে শুরু করে স্থানীয় লোকজন পর্যন্ত সবাই ইব্রাহিমকে শ্রদ্ধার চোখে দেখেন। বাজারের এক পুরনো ব্যবসায়ী আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘উনি শুধু একজন পত্রিকা বিক্রেতা না, তিনি একজন কুরআনের হাফেজও। যতটুকু আয় করেন, তাতেই সন্তুষ্ট। কখনো কারো কাছে কিছু আশা করেন না, খুব ইমানদার মানুষ।’
মো. ফারুকুল ইসলাম নামে একজন বলেন, আমি ছাত্রজীবনে তার অধীনে কাজ করেছি দীর্ঘদিন। কোনোদিন তিনি আমার সাথে খারাপ আচরণ করেননি। খুবই ধার্মিক ও ভালো মনের মানুষ।
ঘোড়াশালের ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম আফজাল জানান, সেই শৈশব থেকে দেখে আসছি মো. হাফেজ ইব্রাহিম পত্রিকা পৌঁছে দিচ্ছেন পাঠকদের কাছে। আমার প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত পত্রিকা পৌঁছে দিচ্ছেন তিনি। সকাল হলেই তার দেওয়া পত্রিকা হাতে নিয়ে পড়ছি।
মিডিয়ার আলো থেকে বহু দূরে, কোনো খবরের হেডলাইন না হয়ে, ইব্রাহিম নিজের জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে লিখে যাচ্ছেন এক অসাধারণ সংগ্রামের গল্প। যিনি প্রমাণ করেছেন- সততা, পরিশ্রম ও আত্মমর্যাদা কখনো পুরনো হয় না। সময় যতই বদলাক না কেন, এমন মানুষেরাই সমাজের মেরুদণ্ড হয়ে থাকেন।
একুশে সংবাদ/ ন.প্র /এ.জে