আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপিকে আলোচনার আহবান জানিয়ে চিঠি দিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। তবে সেই আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেছে বিএনপি।
বুধবার (২৯ মার্চ) গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানান দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। মঙ্গলবার বিএনপির স্থায়ী কমিটির ভার্চ্যুয়াল বৈঠকের সিদ্ধান্ত জানাতে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, বৈঠকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল কর্তৃক মহাসচিবকে প্রেরিত পত্রটির বিষয়ে আলোচনা হয়। পত্রে বিএনপিকে আনুষ্ঠানিক না হলেও অনানুষ্ঠানিক আলোচনা ও মতবিনিময়ের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। তবে বৈঠক মনে করে, বর্তমানের মূল রাজনৈতিক সংকট নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়টি নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে কোনো আলোচনা অথবা সংলাপ ফলপ্রসূ হবে না এবং তা হবে অর্থহীন।
‘২০১৪ এবং ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রমাণিত হয়েছে যে, নির্বাচন কমিশন স্বাধীন নয় এবং ইচ্ছা থাকলেও নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষমতা কমিশনের নেই। আর যেহেতু মূল রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানের কোনো সম্ভাবনা নির্বাচন কমিশন প্রস্তাবিত আলোচনা ও মতবিনিময়ে সম্ভব নয়, সে কারণে বিএনপি এই প্রস্তাব গ্রহণ করতে পারছে না। পত্র প্রেরণের জন্য বৈঠকে প্রধান নির্বাচন কমিশনকে ধন্যবাদ জানানো হয়। ’
মির্জা ফখরুল আরও বলেন, পবিত্র রমজান মাসে দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতির কারণে জনজীবন সীমাহীন দুর্ভোগের মধ্যে পড়েছে। অথচ অবৈধ সরকারের মন্ত্রী এবং শাসক দলের নেতাদের—‘জিনিসপত্রের দাম জনগণের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যেই রয়েছে এবং এত মানুষ লাইন দিয়ে ইফতার সামগ্রী কিনছেন প্রমাণ করে যে, তাদের আয় বেড়েছে’; এমন জনগণের সঙ্গে নিকৃষ্ট ধরনের মশকরা ছাড়া আর কিছু নয়।
তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর বার বার সরকারকে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান করলেও সরকার এ ব্যাপারে উদাসীন। সরকারি দলের ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট ও এক শ্রেণির কর্মকর্তাদের দুর্নীতির কারণেই দ্রব্যমূল্য কমানোর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। এই জনবিচ্ছিন্ন সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। বিএনপি ইতোমধ্যে অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে দেশব্যাপী কর্মসূচি নিয়েছে।
ইউরোপ ও আমেরিকা প্রবাসী সাংবাদিকদের দেশে বসবাসকারী নিকট আত্ময়ীয়দের ওপর হামলা ক্রমাগতভাবে বেড়ে চলায় বৈঠকে গভীর ক্ষোভ, উদ্বেগ ও নিন্দা প্রকাশ করা হয় উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল বলেন, সম্প্রতি আন্তর্জাতিক টিভি চ্যানেল ‘আল-জাজিরায়’ বাংলাদেশে মোবাইল টেলিফোন আড়িপাতার লক্ষ্যে বিদেশ থেকে প্রযুক্তি ক্রয়ের বিষয়ে সরকারের যোগসাজশ সম্পর্কিত তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশকারী সাংবাদিক জুলকার নাইন সায়ের খানের ভাই মাহিনুর আহমেদ খানকে গত ১৭ মার্চ সাদা পোশাকধারী লোকেরা মারাত্মকভাবে কুপিয়ে আহত করার বিষয়ে গভীর ক্ষোভ, উদ্বেগ ও নিন্দা প্রকাশ করা হয়।
এছাড়াও বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপ প্রবাসী কয়েক জন সাংবাদিকদের দেশে বসবাসরত পরিবারের ওপর আক্রমণ, হুমকির নিন্দা জানানো হয়। বিশেষ করে, যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী সাংবাদিক কনক সারোয়ারের গৃহবধূ বোনকে গ্রেফতার এবং মিথ্যা মামলায় কারাগারে প্রেরণের নির্যাতনের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানানো হয়। অবিলম্বে সাংবাদিক এবং তাদের পরিবারবর্গের প্রতি ভীতি প্রদর্শন এবং সকল ধরনের নির্যাতন বন্ধ করার দাবি জানানো হয় বলে জানান মির্জা ফখরুল।
বৈঠকে রাষ্ট্রীয় সংস্থা বাংলাদেশ বিমানের ই-মেইল সার্ভার হ্যাকারদের কবলে পড়ার সংবাদে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয় জানিয়ে তিনি বলেন, ইতোপূর্বে ২০১৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি সাইবার আক্রমণের কবলে পড়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরির এখন পর্যন্ত কোনো সুরাহা করতে না পারা সরকারের ব্যর্থতা এবং কোনো প্রভাবশালী মহলের সংশ্লিষ্টতা প্রমাণ করে। ডিজিটাল সিকিউরিটির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোর সাইবার নিরাপত্তা রক্ষা করতে ব্যর্থ হচ্ছে সরকার।
‘প্রকৃত পক্ষে সাইবার নিরাপত্তার নামে সরকার নিপীড়নমূলক আইন তৈরিতেই ব্যস্ত একই সঙ্গে এই আইনের অপ্রয়োগের মাধ্যমে ভিন্ন মত পোষণকারী সাংবাদিক, সাধারণ নাগরিক ও বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ওপরে নির্যাতনে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করে নিজেদের অবৈধ ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী কারার হীন চক্রান্ত করছে। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান গুলোর আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করনে চূড়ান্তভাবে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। ’
বিএনপি সহাসচিব বলেন, গত ২২ মার্চ বাংলাদেশ সরকারের ভূমি দপ্তরে কর্মচারী সুলতানা জেসমিনকে র্যাব কর্তৃক বেআইনিভাবে তুলে নেওয়া এবং নির্যাতনের ফলে তার মৃত্যুর ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানানো হয়। বৈঠক মনে করে, সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে একজন মহিলাকে কোনো সুনির্দিষ্ট মামলা ব্যতিরেকে তুলে নেওয়া এবং ফলশ্রুতিতে মৃত্যু আবারও প্রমাণ করেছে, এই সরকারের অধীনে কর্মরত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা যথেচ্ছভাবে মানবাধিকার লংঘন করেই চলেছে।
তিনি বলেন, হাইকোর্ট ইতোমধ্যে বিষয়টি আমলে নিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেলকে সকল তথ্য উপস্থাপন করতে নির্দেশ দিয়েছেন। সংবাদ মাধ্যমগুলো ইতোমধ্যে এ বিষয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করছে। এ কথা নিঃসন্দেহে প্রমাণিত যে, সুলতানা জেসমিন র্যাব কাস্টডিতে মারা গেছেন, যা চরমভাবে মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন। আন্তর্জাতিক অধিকার সংস্থাগুলো এ বিষয়ে অবিলম্বে নিরপেক্ষ তদন্ত অনুষ্ঠানের দাবি জানিয়েছে। অবিলম্বে নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত তথ্য জনসম্মুখে উপস্থাপনের দাবি জানাচ্ছি এবং সুলতানা জেসমিনকে হত্যার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানাচ্ছি।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সভাপতিত্বে বৈঠকে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড. আব্দুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সালাহ উদ্দিন আহমেদ, বেগম সেলিমা রহমান, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু উপস্থিত ছিলেন।
একুশে সংবাদ/ঢ/এসএপি
আপনার মতামত লিখুন :