চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালিতে পৌঁছেছেন প্রায় ৯ হাজার ৭৩৫ জন বাংলাদেশি, যা ইউরোপে সাগরপথে প্রবেশকারী অভিবাসনপ্রত্যাশী দেশের তালিকায় বাংলাদেশকে শীর্ষস্থানে রেখেছে।একই সময়ে ইরিত্রিয়া, মিসর, পাকিস্তান ও ইথিওপিয়া থেকে এসেছে যথাক্রমে চার হাজার ৩৪৮, তিন হাজার ৫৫৬, দুই হাজার ৬২৫ জন ও এক হাজার ৪৩০ জন।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম জানিয়েছে, গত ১২ বছরে এই পথ ধরে অন্তত ৭০ হাজার বাংলাদেশি ইউরোপে প্রবেশ করেছেন। তাদের অনেকেই লিবিয়ার বিভিন্ন বন্দিশিবিরে ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, পরিবার থেকে আদায় করা হয়েছে মুক্তিপণ, এমনকি প্রাণ হারানোর ঘটনাও ঘটেছে।
ব্র্যাকের সহযোগী পরিচালক শরিফুল হাসান বলেন, “ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালিতে যাওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশি তরুণদের মধ্যে এক অদ্ভুত মরিয়া প্রবণতা কাজ করছে। বহু মানুষ জানেন না, এই যাত্রাপথ কতটা বিপদসংকুল।”
ব্র্যাকের তথ্যমতে, যেসব জেলার মানুষ সবচেয়ে বেশি এই বিপজ্জনক যাত্রায় অংশ নিচ্ছেন, তার মধ্যে রয়েছে মাদারীপুর, শরীয়তপুর, ফরিদপুর, সিলেট, সুনামগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নোয়াখালী ও কুমিল্লা। এদের অধিকাংশই ২৫ থেকে ৪০ বছর বয়সী।
বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, বিশেষ করে ফেসবুক, মানবপাচার চক্রের অন্যতম মাধ্যম হয়ে উঠেছে। লোকপ্রলোভনের ফাঁদে ফেলে চাকরি বা ইউরোপে ভালো জীবনের স্বপ্ন দেখিয়ে পাচারকারীরা মানুষ পাঠাচ্ছে লিবিয়ায়। কিন্তু বাস্তবে অনেকেই সেখানে গিয়ে বন্দি হচ্ছেন, পাচ্ছেন না কোনো কাজ, বরং পড়ছেন নানাবিধ নির্যাতন ও শোষণের মধ্যে।
ব্র্যাকের এক গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব বাংলাদেশি লিবিয়ার হয়ে ইউরোপের দিকে রওনা দেন, তাদের ৬০ শতাংশের পরিবারকে দালালরা চাকরির আশ্বাস দিয়ে প্রলুব্ধ করেছিল। কিন্তু তাদের মধ্যে ৮৯ শতাংশ কোনো চাকরি পাননি।
সাধারণত ঢাকা থেকে দুবাই, মিসর, তুরস্ক কিংবা কাতার হয়ে লিবিয়ায় পৌঁছান তারা। এরপর সেখান থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালিতে প্রবেশের চেষ্টা চলে। যাত্রাপথে ৬৩ শতাংশই বন্দি হন, যাদের মধ্যে ৯৩ শতাংশ বন্দি অবস্থায় ছিলেন শিবিরে, এবং ৭৯ শতাংশ শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন। এমনকি ২২ শতাংশ দিনে মাত্র এক বেলা খাবার পেয়েছেন বলে জানান।
চলতি বছরের জানুয়ারিতেই লিবিয়ার একটি মরুভূমি এলাকা থেকে ২৩ বাংলাদেশির মরদেহ উদ্ধার করা হয়। তারা সবাই ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে প্রাণ হারান। ইউরোপীয় সীমান্ত সংস্থা ফ্রন্টেক্স জানিয়েছে, শুধু সেন্ট্রাল মেডিটেরিয়ান রুট ধরেই ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ৯২ হাজার ৪২৭ জন বাংলাদেশি ইউরোপে প্রবেশ করেছেন।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালেই মানবপাচার আইনে এক হাজার ৩৪টি নতুন মামলা হয়েছে। আর চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত বিচারাধীন ও তদন্তাধীন মামলার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৩৬০টি। এর মধ্যে তিন হাজার ১৪টি মামলার বিচার এখনো চলছে এবং এক হাজার ৩৪৬টি মামলা তদন্ত পর্যায়ে রয়েছে।
যদিও ২০১২ সালে মানবপাচার প্রতিরোধে আইন প্রণয়ন করা হয়, বাস্তবে দালাল ও চক্রের মূল হোতারা প্রায়শই আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে যান। ফলে আইনের বাস্তব প্রয়োগ ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত না হওয়ায় পাচার বন্ধ হচ্ছে না।
৩০ জুলাই বিশ্বজুড়ে পালিত হবে আন্তর্জাতিক মানব পাচার বিরোধী দিবস। জাতিসংঘ ২০১৩ সালে দিনটিকে স্বীকৃতি দেয়। এ বছরের প্রতিপাদ্য: “সংঘবদ্ধ অপরাধ মানবপাচার, বন্ধ হোক শোষণের অনাচার।”
একুশে সংবাদ/ঢ.প/এ.জে