সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীকে ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত আইন’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে দেশের সর্বোচ্চ আদালত। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ বৃহস্পতিবার (৫ জুন) ওয়েবসাইটে ৫০ পৃষ্ঠার রিভিউ রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ করেছে।
এই রায়ে সর্বসম্মতিক্রমে সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ সম্পূর্ণরূপে পুনর্বহাল করা হয়েছে। এর মাধ্যমে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের পরিবর্তে আবারও সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতে ফিরেছে।
রিভিউ আবেদনের ওপর গত বছরের ২০ অক্টোবর প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন ছয় সদস্যের বেঞ্চ এ রায় দিয়েছিল।
রায়ে প্রধান বিচারপতি ড. রেফাত আহমেদ বলেন, “বিচারপতিদের আচরণবিধি পর্যালোচনা ও সংশোধনের জন্য সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের স্বতন্ত্র ক্ষমতা রয়েছে। সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের সাংবিধানিকতা বিচার বিভাগীয় স্বাধীনতার ভিত্তিপ্রস্তর।”
তিনি আরও বলেন, “সংবিধানের মৌলিক কাঠামো ভেঙে ফেলার যেকোনও প্রচেষ্টা গণতন্ত্রের জন্য হুমকি। রিভিউ রায়ের মাধ্যমে সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদে থাকা বিচারপতির পদত্যাগের ধারা-সহ (ধারা ২–৮) সব কিছুই পুনরুজ্জীবিত করা হলো।”
বিচারপতি সৈয়দ জিয়াউল করিম বলেন, “ষোড়শ সংশোধনী ছিল একটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত আইন, যা নির্বাহী, বিচার ও আইন বিভাগের ক্ষমতার ভারসাম্য নষ্ট করে। এটি সংবিধানের ৭(খ), ৯৪(৪) ও ১৪৭(২) অনুচ্ছেদ লঙ্ঘন করে।”
বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম বলেন, “রায়ে সংযুক্ত কিছু বিধি বিভ্রান্তি তৈরি করে, যা বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় প্রভাব ফেলে। সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ সেই ভারসাম্য রক্ষার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”
বিচারপতি রেজাউল হক বলেন, “বিচারকের পদত্যাগের অধিকার একটি মৌলিক বিষয়। এটি সংবিধানে পুনর্বহাল করাই যুক্তিসঙ্গত।”
রায়ে বলা হয়, ১৯৭২ সালের সংবিধানে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ছিল। ১৯৭৫ সালের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে এ ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে চলে যায়। এরপর জিয়াউর রহমানের শাসনামলে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের মাধ্যমে বিচারকদের অপসারণ প্রক্রিয়া নির্ধারিত হয়।
২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংসদে পাস হয় ষোড়শ সংশোধনী, যা বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে দেয়।
এই সংশোধনীকে চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করেন ৯ জন আইনজীবী। শুনানি শেষে ২০১৬ সালে হাইকোর্ট বেঞ্চ এটি অবৈধ ঘোষণা করে। এরপর ২০১৭ সালে আপিল বিভাগও রায় বহাল রাখে এবং ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে।
২০১৭ সালের ২৪ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপক্ষ ৯০৮ পৃষ্ঠার রিভিউ আবেদন করে। শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল ও অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেলরা। রিটের পক্ষে ছিলেন মনজিল মোরসেদ।
১০ জন সিনিয়র আইনজীবী অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে মত দেন, যাদের মধ্যে ৯ জন ছিলেন ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পক্ষে। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন আজমালুল হোসেন কিউসি।
এই রায়ে আবারও নিশ্চিত হলো যে বিচার বিভাগীয় স্বাধীনতা রক্ষায় সংসদের পরিবর্তে বিচারপতিদের অপসারণ প্রক্রিয়া সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমেই হবে। ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে যে ‘রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের’ সুযোগ তৈরি হয়েছিল, তা বন্ধ হলো এই রায়ের মাধ্যমে।
সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, এটি ছিল শুধুই একটি ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ সংশোধনী— যা সাংবিধানিক ভারসাম্য ও মৌলিক কাঠামোর পরিপন্থি।
একুশে সংবাদ/আ.ট/এ.জে