বাংলার লোকসঙ্গীত মানেই দোতারার মায়া। আর সেই মায়ার সেতুতে প্রথম যে নাম উচ্চারিত হয়, তিনি কিংবদন্তি শিল্পী কানাই লাল শীল। আজ তাঁর ৪৯তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৭৬ সালের ৫ সেপ্টেম্বর তিনি দোতারা নামিয়ে রেখে চিরদিনের মতো চলে গেলেও তাঁর সুরের জাদু আজও বাংলার ঘরে ঘরে বাজে।
ফরিদপুর জেলার নগরকান্দা থানার লস্করপুর (কৈড়াইল) গ্রামে ১৩০৫ বঙ্গাব্দে জন্ম নেন তিনি। পিতা আনন্দ চন্দ্র শীল, মাতা সৌদামিনি শীল, এবং স্ত্রী কিশোরী বালা শীল। শৈশবেই হাতে খড়ি হয়েছিল দোতারায়, আর কণ্ঠে এসেছিল সুরের পরশ। সেই ছোট্ট ছেলে একদিন হয়ে উঠেছিলেন উপমহাদেশের এক অনন্য দোতারা বাদক, সুরকার ও গীতিকার।
তাঁর সৃষ্টি গানগুলো যেন বাংলার লোকজ জীবনের দিনলিপি—‘তোমারও লাগিয়ারে’, ‘বহুদিনের পিরিত গো বন্ধু’, ‘শোন গো রূপসী কন্যা গো’, ‘মাঝি বাইয়া যাও রে’, ‘আমায় এতো রাতে কেন ডাক দিলি’, ‘অসময় বাঁশি বাজায় কে রে’—সবই কালজয়ী। তাঁর লেখা ও সুর করা গান কণ্ঠে তুলেছেন আব্বাসউদ্দিন আহামেদ, শচীন দেব বর্মন, আবদুল আলীম, কুমুদিনী সাহা, ফেরদৌসী রহমান, মোস্তফা জামান আব্বাসীসহ বহু কিংবদন্তি শিল্পী।
কানাই লাল শীলকে বলা হয় ‘দোতারার জাদুকর’। তাঁর হাতে দোতারা যেন বেঁচে উঠত, কথা বলত, হাসত-কাঁদত। ভাটিয়ালি, মারফতি, ভাওয়াইয়া কিংবা পালাগান—সব ধারাতেই তিনি প্রাণ সঞ্চার করতেন। নদীর ঢেউ, মাঠের হাওয়া, গ্রামীণ জীবনের সুখ-দুঃখ, ভালোবাসা আর বেদনা—সবকিছুই ধরা দিত তাঁর গানে।
গ্রামীণ মেলার সরল আড্ডা থেকে শহরের সাংস্কৃতিক আসর—সবখানেই তিনি ছিলেন প্রিয়জনের মতো। লোকগানের সহজ অথচ গভীর সুরে তিনি মানুষের অন্তর ছুঁয়ে যেতেন, মাটির টান জাগিয়ে তুলতেন।
আজ তাঁর প্রয়াণ দিবসে দেশের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন আয়োজন করেছে স্মরণানুষ্ঠান, আলোচনা সভা ও লোকগানের আসর। অনুরাগীদের বিশ্বাস, কানাই লাল শীলের অবদান না থাকলে বাংলা লোকসঙ্গীত হয়তো এত দূর পৌঁছাতে পারত না।
যতদিন দোতারার তারে ঝংকার তোলা সুরে বাংলার মাটি দুলবে, ততদিন বেঁচে থাকবেন কানাই লাল শীল। তিনি শুধু এক শিল্পী নন—তিনি বাংলার লোকসঙ্গীতের আত্মা।
একুশে সংবাদ/এ.জে