রেনেসাঁ ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশন-এর চেয়ারম্যান আতাউর রহমান বলেন, “নাম হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘কিশোর গ্যাং’। দিন দিন এদের পরিসর বেড়েই চলেছে। বলা যায়, এদের প্রকোপে গোটা সমাজ বিব্রত ও শঙ্কিত। যদিও ‘কিশোর গ্যাং’ বলা হয়, কিন্তু এর অধিকাংশ সদস্যই তরুণ এবং ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে। এদের কারণে সামাজিক অবক্ষয় ও অস্থিতিশীলতা দিন দিন চরম আকার ধারণ করছে।”
তিনি বলেন, “কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা সারা দেশে আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি, চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানি, ইভটিজিং, ধর্ষণ, মাদক ব্যবসা এবং জোরপূর্বক জমি দখলের মতো অপরাধে জড়িত। তারা তথাকথিত ‘হিরোইজম’ দেখানো কিংবা সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার জন্য এসব অপরাধ করে। টিকটক, লাইকি ইত্যাদি মাধ্যমে প্রভাবিত হয়ে অনেক কিশোর এসব গ্যাংয়ে নাম লেখায়। তাদের পেছনে থেকে কথিত গডফাদার ও রাজনৈতিক বড় ভাইয়েরা নিয়ন্ত্রণ করে। অথচ তারা বেশির ভাগ সময়ই ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়।”
আতাউর রহমান বলেন, “অনেক সময় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতেও এসব গ্যাং ব্যবহার করা হচ্ছে। গ্যাংগুলোর নামও অদ্ভুত— যেমন: ‘লাড়া দে’, ‘গ্রুপ টোয়েন্টি ফাইভ’, ‘স্টার বন্ড’, ‘পাওয়ার বয়েজ’ ইত্যাদি। পত্রপত্রিকা ও সংস্থার তথ্যমতে, দেশে বর্তমানে প্রায় ২৩৭টি কিশোর গ্যাং রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরেই রয়েছে ১৮৪টি। রাজধানীতে ২০২৩ সালে যত খুন হয়েছে, তার অন্তত ২৫টি কিশোর গ্যাং সংশ্লিষ্ট। চট্টগ্রামে কিশোর গ্যাংয়ের হামলায় গত বছর এপ্রিলে চিকিৎসক কোরবানী আলী নিহত হন— যা অত্যন্ত মর্মস্পর্শী ও দুঃখজনক।”
তিনি আরও বলেন, “তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীও কিশোর গ্যাং ইস্যুতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বিশেষ নির্দেশনা দেন। এখন প্রশ্ন হলো— এই কিশোর গ্যাং রোধে কী করা যায়? এর জন্য আইনের শাসন কঠোর করার পাশাপাশি পারিবারিক শিক্ষাকেও সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে।”
পারিবারিক অবক্ষয় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “আগে একান্নবর্তী পরিবারে গল্প-আড্ডা, খাওয়া-দাওয়া, হাসি-ঠাট্টার মাধ্যমে পারস্পরিক সম্পর্ক দৃঢ় হতো। কিন্তু এখন একক পরিবারে মা-বাবারাই সন্তানদের সময় দিতে চান না। সন্তান একটু সময় ও সঙ্গ চায়, কিন্তু বাবা-মা তার হাতে মোবাইল ধরিয়ে দেন, নিজেরাও মোবাইলে ব্যস্ত থাকেন। এতে সন্তান নিজেকে একাকী মনে করে এবং বন্ধু-বান্ধবের প্রতি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, যা একসময় বিপথে ঠেলে দেয়।”
তিনি বলেন, “সন্তানদের বন্ধু হয়ে উঠতে হবে মা-বাবাদেরই। তাদের মনের দুঃখ বোঝার চেষ্টা করতে হবে। পরিবারের ভালোবাসা ও নৈতিক মূল্যবোধের শিক্ষাই সন্তানের নিরাপদ বিকাশ নিশ্চিত করতে পারে। পরিবারই হলো প্রথম বিদ্যাপীঠ।”
দারিদ্র্যের প্রভাব তুলে ধরে তিনি বলেন, “কিশোর অপরাধ বিশ্লেষণে বোঝা যায়— এর পেছনে দারিদ্র্য একটি বড় কারণ। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ভাসমান শিশুরা অপরাধে জড়িত। দেশে এখন ১৫ লাখেরও বেশি পথশিশু রয়েছে, যারা বস্তি ও ফুটপাতে বাস করে। মা-বাবার অবহেলা কিংবা পরিচয়হীনতা তাদের অপরাধ জগতে ঠেলে দিচ্ছে। কিছুটা আর্থিক সচ্ছলতা পাওয়ার আশায় তারা গ্যাংয়ে যুক্ত হচ্ছে।”
এক্ষেত্রে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা গুরুত্বপূর্ণ বলে তিনি মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, “এনজিও ও বেসরকারি সংস্থাগুলোকে পথশিশুদের পুনর্বাসনের প্রকল্প নিতে হবে। যাদের মা-বাবা নেই, তাদের জন্য তত্ত্বাবধায়ক ও কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ প্রয়োজন।”
সমাধানের পথ হিসেবে আতাউর রহমান বলেন, “এই সমস্যা বহুমাত্রিক। তাই সমাধানও হতে হবে সমন্বিত। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র সবার দায়িত্ব আছে। পরিবার থেকেই প্রতিরোধের সূচনা হওয়া উচিত। মা-বাবা সন্তানের পাশে বটবৃক্ষ হয়ে দাঁড়ালে তাদের সঠিক পথে রাখা সম্ভব।”
তিনি বলেন, “প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কাউন্সেলিং সেন্টার স্থাপন ও সক্রিয় করা উচিত। মসজিদসহ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান থেকে সচেতনতা গড়ে তোলা জরুরি। কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে প্রচারাভিযান চালাতে হবে।”
শেষে আতাউর রহমান বলেন, “আইনের শাসন জোরদার ও সরকারের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া এই বিষফোঁড়াকে নির্মূল করা সম্ভব নয়। তবে সম্মিলিতভাবে চেষ্টা করলে ইনশাআল্লাহ কিশোর গ্যাং প্রতিরোধ ও নির্মূল সম্ভব।”
একুশে সংবাদ/ন.প্র/এ.জে