চুয়াডাঙ্গার বিভিন্ন স্থানে অরক্ষিত ও অনুমোদনহীন রেলগেটগুলো যেন প্রতিনিয়ত মৃত্যুফাঁদে পরিণত হচ্ছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত মাত্র সাত মাসে ট্রেনে কাটা পড়ে প্রাণ হারিয়েছেন ৯ জন।
সবশেষ ৮ জুলাই চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার আমিরপুর গ্রামে রেললাইনের ওপর দিয়ে পার হতে গিয়ে ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যু হয় জীবন আলী (২৫) নামে এক তরুণের। নিহত জীবন আলী ওই গ্রামেরই বাসিন্দা। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, তিনি এক ট্রেন পার হওয়ার পর নিরাপদ ভেবে রেললাইন অতিক্রম করছিলেন। ঠিক সে সময় বিপরীত দিক থেকে আসা আন্তঃনগর রূপসা এক্সপ্রেস ট্রেনে কাটা পড়েন তিনি। ট্রেনের ইঞ্জিনে জড়িয়ে তার মরদেহ ছিটকে পড়ে প্রায় ১০০ মিটার দূরে। তার মোটরসাইকেল টেনে নিয়ে যায় আরও প্রায় এক কিলোমিটার দূরে টেংরামারি গ্রাম পর্যন্ত। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় তার। মরদেহ ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
ঘটনার পর উত্তেজিত স্থানীয় জনতা ট্রেন অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখায় এবং দ্রুত স্থায়ী রেলগেট ও গেটম্যান নিয়োগের দাবি তোলে।
এছাড়াও ৫ জুলাই রাতে মুন্সীগঞ্জ বেদবাড়ি এলাকায় রেললাইনের পাশে এক অজ্ঞাত ব্যক্তির মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ, যিনি ট্রেনে কাটা পড়ে মারা যান বলে ধারণা করা হচ্ছে।
চুয়াডাঙ্গা রেলওয়ে সূত্র জানায়, জেলায় মোট ৩০টি বৈধ রেলগেট রয়েছে। এর মধ্যে ১৫টি গেটে কোনো গেটম্যান নেই। এছাড়া অনুমোদনহীন গেট রয়েছে ৫টি এবং স্থানীয়ভাবে ব্যবহৃত আরও ২৫টি রেললাইন পারাপারের রাস্তা রয়েছে, যেগুলো মানবসৃষ্ট ও অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।
অনেক বৈধ গেটেও গেটম্যান না থাকায় সেগুলোও পরিণত হয়েছে দুর্ঘটনার কেন্দ্রে। আর অবৈধ রেলক্রসিংগুলোর পাশে সাইনবোর্ড টানিয়ে দায় সেরেছে রেল কর্তৃপক্ষ।
রেলগেট না থাকায় শিক্ষার্থী, পথচারী, ছোট-বড় যানবাহন ও বিভিন্ন প্রাণী নির্বিঘ্নে রেললাইনের ওপর দিয়ে চলাচল করছে। গেটম্যান না থাকায় স্থানীয় দোকানি কিংবা পথচারীরাই মাঝে মাঝে স্বেচ্ছাশ্রমে ট্রেন আসার সংকেত দিয়ে মানুষকে সাবধান করছেন।
স্থানীয়রা অভিযোগ করে বলেন, বারবার রেল কর্তৃপক্ষকে জানানো হলেও কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তারা জানান, যেসব স্থানে মানুষের চলাচল বেশি, সেখানে রেলগেট ও গেটম্যান না থাকায় এমন দুর্ঘটনা বাড়ছে।
চুয়াডাঙ্গার রেলপথ প্রায় ৪০ কিলোমিটার দীর্ঘ। এই পথে খুলনা থেকে আন্তঃনগর, মেইল ও মালবাহী ট্রেন প্রতিদিন নিয়মিত চলাচল করে। অথচ নিরাপত্তা ব্যবস্থার এমন বেহাল দশা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এলাকাবাসী।
চুয়াডাঙ্গা জিআরপি (রেলওয়ে পুলিশ) ফাঁড়ির ইনচার্জ জগদীশ চন্দ্র বসু জানান, “গত সাত মাসে চুয়াডাঙ্গায় ট্রেনে কাটা পড়ে মারা গেছেন ৯ জন। প্রতিটি ঘটনারই আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সর্বশেষ আমিরপুরে একটি অবৈধ রেলগেটের কাছে যুবকের মৃত্যু হয়েছে, যা অত্যন্ত মর্মান্তিক। ওই স্থানে একটি রেলগেট অত্যন্ত জরুরি।”
চুয়াডাঙ্গা রেলওয়ের সহকারী নির্বাহী প্রকৌশলী গোলাম মোস্তফা বলেন, “চুয়াডাঙ্গায় ৩০টি বৈধ রেলগেটের মধ্যে ১৫টিতে গেটম্যান নেই। লোকবল সংকটের বিষয়টি আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। গেটম্যান বরাদ্দ পেলে সমস্যা অনেকটাই কমে যাবে। অবৈধ রেলক্রসিংয়ের সংখ্যা আমাদের হিসেবে ৫টি হলেও বাস্তবে তা আরও বেশি হতে পারে।”
চুয়াডাঙ্গায় অরক্ষিত রেলক্রসিংগুলোর ঝুঁকি দিন দিন বাড়ছে। একদিকে রেলগেট নেই, অন্যদিকে জনসচেতনতার অভাব—এই দুইয়ের কারণে একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। এখনই প্রয়োজন যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ। না হলে এই মৃত্যুফাঁদে আরও তাজা প্রাণ ঝরে যাবে।
একুশে সংবাদ/চু.প্র/এ.জে