ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন (পিআইও) অফিস।ঘুষ ও দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে আগের পিআইও বিজন কৃষ্ণ খরাতিকে বদলি ও সাময়িক বরখাস্ত করা হলেও কিছুতেই থামছে না এ ঘুষ বাণিজ্য।
কর্তৃপক্ষের পছন্দের লোকদের অফিসে বসিয়ে চালানো হচ্ছে দাপ্তরিক কার্যক্রম ও ঘুষ বাণিজ্য। এসব লোকদের মাধ্যমে প্রতিটি প্রকল্পের বরাদ্দ থেকে ১০ শতাংশ হারে ঘুষ নেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
দীর্ঘ এক যুগ ধরে এই অফিসে দাপ্তরিক কার্যক্রম, সাইট পরিদর্শন ও মাস্টাররোল তৈরির কাজ করছেন বহিরাগত আল আমিন। নতুনভাবে যুক্ত হয়েছেন আরেক বহিরাগত বাচ্চু মিয়া। আল আমিন নলছিটি পৌরসভার নান্দিকাঠি গ্রামের মৃত জজ আলীর ছেলে এবং বাচ্চু ভাণ্ডারিয়া উপজেলার ধাওয়া গ্রামের মৃত ইউসুফ হাওলাদারের ছেলে। আল আমিন শিক্ষাযোগ্যতা ৯ম শ্রেণি এবং বাচ্চু ৫ম শ্রেণি পাস।
দু’জনই কোনোভাবে সরকারি কর্মচারী, মাস্টাররোলে বা আউটসোর্সিংয়ে নিয়োগপ্রাপ্ত নন। বাচ্চু চলতি বছরের মার্চ থেকে এ অফিসে কম্পিউটার অপারেটরের কাজ করছেন।
২০২৪ সালের ১৪ নভেম্বর নতুন পিআইও মো. আওলাদ হোসেন দায়িত্ব নেন নলছিটিতে। এর আগে তিনি ছিলেন ভাণ্ডারিয়ায়, সেখান থেকেই নিজের বিশ্বস্ত লোক বাচ্চুকে নিয়ে আসেন এবং অফিসে বসিয়ে দেন। আল আমিন ও বাচ্চু দু’জনের জন্য অফিস কক্ষে নির্দিষ্ট চেয়ার-টেবিলও রয়েছে। প্রতিদিন অফিস করছেন তারা। অনেকেই তাদের অফিসের স্থায়ী কর্মচারী মনে করে সমীহ করেন।
বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ পরিদর্শনেও তারা যান। মাপজোকের কাজ করেন আল আমিন। মাস্টাররোল তৈরির সম্পূর্ণ দায়িত্বও তার। মাস্টাররোল তৈরির জন্য দিতে হয় বাড়তি ২০০০ টাকা। প্রকল্প কমিটির কেউ মাস্টাররোল জমা দেয় না, আল আমিনই লেখে।
এছাড়াও , টিআর, কাবিখা, কাবিটাসহ বিভিন্ন প্রকল্পে বরাদ্দ পাওয়া প্রতিটি প্রকল্প থেকে ১০ শতাংশ ঘুষ দিতে হয় অফিসে। যা এখন অলিখিত নিয়মে পরিণত হয়েছে।
সাবেক পিআইও বিজন কৃষ্ণ খরাতির সময় (০১-০৩-২০২০ থেকে ২১-১০-২০২৪) ব্যাপক অনিয়ম হয়। তিনি ৫৮৪টি ঘর নির্মাণের জন্য বরাদ্দকৃত সামগ্রীতে নিম্নমান বজায় রেখে কাজ করেন। তার বিরুদ্ধে ৫৫টি ঘর না বানিয়ে ইউএনও’র স্বাক্ষর জাল করে দেড় কোটির বেশি টাকা উত্তোলনের অভিযোগ রয়েছে। পরে বিষয়টি ধরা পড়লে টাকা সরকারি অ্যাকাউন্টে ফেরত দেন। বর্তমানে ইউএনও মো. নজরুল ইসলাম সেই টাকা ফেরত এনে মাটিভাঙা আবাসনে ঘর নির্মাণ করে দেন। ঠিকাদারদের জামানতেরও লক্ষ লক্ষ টাকা তুলে নিয়েছিলেন তিনি। এসব অনিয়মের প্রাথমিক সত্যতা পেয়ে তাকে সাময়িক বরখাস্ত ও বদলি করে বিভাগীয় মামলা করা হয়।
গত বছরের ৫ আগস্টের আগে কাবিখা, কাবিটা ও ভুয়া টিআর প্রকল্পে ব্যাপক অনিয়মে সরকারি অর্থ লুটের অভিযোগ উঠে। এলাকাবাসীর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) প্রধান কার্যালয় ২০২৫ সালের ২৭ এপ্রিল থেকে তদন্ত শুরু করে।
কুলকাঠি ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মো. বেল্লাল মোল্লা ও সরই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. শাহাদাত হোসেন জানান, তারা দুদক থেকে এ সংক্রান্ত চিঠি পেয়েছেন। প্রধান শিক্ষক জানান, তার বিদ্যালয়ের জন্য কোনো বরাদ্দ পাননি, লিখিতভাবে তা দুদককে জানানো হয়েছে।
অনেক সাবেক ও বর্তমান প্রকল্প চেয়ারম্যানরা স্বীকার করেছেন, অফিসের পার্সেন্টেজের টাকা দিলে সবকিছুই বৈধ হয়ে যায়। মাস্টাররোলও তৈরি করে দেন অফিসের আল আমিন।
বেল্লাল মোল্লা জানান, সরই প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে হাড়িখালি পর্যন্ত রাস্তার সংস্কার প্রকল্পে পিআইও অফিসের আল আমিন মাপ নেন এবং মাস্টাররোল তৈরি করেন। এজন্য তাকে ২০০০ টাকা ও অফিসের জন্য আরও ১২ হাজার টাকা দিতে হয়েছে।
মগড় ইউনিয়ন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মো. জামাল হোসেন জানান, তার প্রকল্পে কাজ পরিদর্শনে এসেছেন আল আমিন। তবে এখনও তিনি টাকা দেননি। তবে অন্যদের কাছ থেকে শুনেছেন, ১০ শতাংশ ঘুষ দাবি করা হচ্ছে।
অভিযুক্ত আল আমিন বলেন, “আমি দীর্ঘদিন ধরে এখানে মাস্টাররোল লিখি। চেয়ারম্যানরা যা দেন, তা নিয়েই চলি। কর্মকর্তা যেটা বলেন, সেটাই করতে হয়।”
বাচ্চু বলেন, “আমি পঞ্চম শ্রেণি পাস। স্যার আমাকে অফিসে এনেছেন। আমি কম্পিউটারে কাজ করি। কিন্তু কেন জিজ্ঞেস করছেন? আমার কোনো ক্ষতি হবে না তো?”
পিআইও মো. আওলাদ হোসেনকে ঘুষের বিষয় জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, “আমি এখন শুনলাম।” বহিরাগতদের দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করানো প্রসঙ্গে তিনি নিরুত্তর থাকেন। তবে জনবল সংকটের কথা উল্লেখ করেন।
নলছিটি ইউএনও মো. নজরুল ইসলাম বলেন, “আল আমিন ও বাচ্চু কোনো নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মচারী নন। তারা অনিয়ম করলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
একুশে সংবাদ/ঝা.প্র/এ.জে