জয়পুরহাট জেলার ক্ষেতলাল উপজেলার মামুদপুর ইউনিয়নের মহব্বতপুর গ্রামে তুলশীগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত প্রাচীন সন্ন্যাসতলীর বটতলায় প্রতি বছর জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষ শুক্রবার শুরু হয় ঐতিহ্যবাহী ঘুড়ির মেলা। প্রায় দুই শতাব্দী ধরে চলে আসা এই মেলাটি এখন আর শুধুই পূজাকেন্দ্রিক উৎসব নয়, বরং হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সব ধর্ম-বর্ণের মানুষের এক প্রাণবন্ত মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে।
স্থানীয় প্রবীণদের ভাষ্যমতে, এই ঘুড়ি মেলার সূচনা হয় কমপক্ষে ২০০ বছর আগে। যদিও সুনির্দিষ্ট ইতিহাস কারও জানা নেই, তবে জনশ্রুতি অনুযায়ী, হিন্দু সম্প্রদায়ের সন্ন্যাসী পূজাকে কেন্দ্র করেই এর সূচনা। প্রতি বছর পঞ্জিকা অনুযায়ী জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষ শুক্রবার বিকেলে সন্ন্যাস মন্দিরে পূজা-অর্চনার মাধ্যমে মেলার সূচনা হয়।
মেলার কোনো নির্দিষ্ট সীমানা না থাকলেও, এর বিস্তৃতি ছড়িয়ে পড়ে প্রায় দুই কিলোমিটার এলাকা জুড়ে—জামালগঞ্জ চারমাথা থেকে শুরু করে ঐতিহাসিক আছরাঙ্গা দিঘি পর্যন্ত। রাস্তার দুই পাশে বসে নানা ধরনের দোকান। ঘুড়ির পাশাপাশি মেলায় পাওয়া যায় বাঁশ, কাঠ ও লোহার তৈরি মাছ ধরার যন্ত্র, গৃহস্থালি সামগ্রী, খেলনা, প্রসাধনী, মাটির তৈজসপত্র এবং বাহারি মিষ্টান্নসহ নানা পণ্যের সমারোহ।
মেলার মূল আকর্ষণ নিঃসন্দেহে ঘুড়ি ওড়ানো ও ঘুড়ি বিক্রি। সারাদেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা ব্যবসায়ীরা বাহারি রঙ ও নকশার ঘুড়ি নিয়ে অংশ নেন। এবার বগুড়া, দিনাজপুর ও সিরাজগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলা থেকে আগত দর্শনার্থীরা ঘুড়ি কেনার পাশাপাশি উৎসবের পরিবেশ উপভোগ করেন। যদিও এ বছর তীব্র তাপপ্রবাহ ও বাতাসের অভাবে ঘুড়ি ওড়ানো প্রতিযোগিতা তেমন জমেনি, তবে শিশু-কিশোরদের উচ্ছ্বাস ছিল চোখে পড়ার মতো।
এই মেলা শুধু কেনাকাটার উৎসব নয়, বরং এটি একটি পারিবারিক ও সামাজিক মিলনমেলা। আশপাশের গ্রামের মানুষ জামাই ও আত্মীয়দের নিমন্ত্রণ করে আপ্যায়নের আয়োজন করেন। বিকেলের পর থেকে মানুষের ভিড় বাড়তে থাকে, আর পুরো এলাকা উৎসবমুখর হয়ে ওঠে।
মেলার আয়োজনে হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের সক্রিয় অংশগ্রহণ থাকে। সন্ন্যাস মন্দির কমিটির সভাপতি মন্টু চন্দ্র বলেন, “এই মেলা প্রায় ২০০ বছরের পুরনো। প্রতিবছর আমরা সফলভাবে এর আয়োজন করি। এটি শুধু হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের নয়, সকল মানুষের অংশগ্রহণেই মেলাটি প্রাণ পায়।”
মামুদপুর ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি মামুন বলেন, “সন্ন্যাসতলীর ঘুড়ি মেলা আমাদের ঐতিহ্যের প্রতিচ্ছবি। মেলাকে ঘিরে সব ধর্ম-বর্ণের মানুষ একত্রিত হয়—এটাই এর আসল সৌন্দর্য।”
ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান মিলন হোসেন বলেন, “তিন দিনের এই আয়োজনে এত মানুষের সমাগম হয়—নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। আমরা মেলার সার্বিক শৃঙ্খলা রক্ষায় কঠোর নজরদারিতে থাকি।”
বিপুল জনসমাগম সামাল দিতে প্রশাসন ছিল তৎপর। ক্ষেতলাল থানার অফিসার ইনচার্জ মো. ফরিদ হোসেন জানান, “মেলার সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশ সতর্ক রয়েছে। কোনো অনৈতিক কর্মকাণ্ড সহ্য করা হবে না—প্রয়োজনে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
সন্ন্যাসতলীর শতবর্ষী ঘুড়ি মেলা শুধু একটি উৎসব নয়, বরং জয়পুরহাটের গ্রামীণ ঐতিহ্য ও সামাজিক সংহতির এক উজ্জ্বল নিদর্শন। সময়ের ধারায় অনেক কিছু বদলালেও বদলায়নি মানুষের উৎসাহ, আনন্দ ও পারস্পরিক সম্প্রীতির এই চিরন্তন বন্ধন।
একুশে সংবাদ/জ.প্র/এ.জে