আজ ২১ মে, বিশ্ব চা দিবস। বাংলাদেশে চায়ের প্রতি মানুষের আগ্রহ প্রবল হলেও, চা শিল্পের মূল কারিগর চা শ্রমিকেরা বছরের পর বছর ধরে অবহেলিত ও বঞ্চিতই রয়ে গেছেন। চা শিল্পে রপ্তানি ও উৎপাদনে অগ্রগতি থাকলেও শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি, মৌলিক অধিকার ও উন্নত জীবনমান নিশ্চিত হয়নি।
বাংলাদেশে চা শিল্প পাটের পরে দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানিমুখী খাত। অভ্যন্তরীণ বাজারের আকার প্রায় ৪,১০০ কোটি টাকা। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে রপ্তানি আয় দাঁড়িয়েছে ৪৫৮ কোটি টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় ১২ শতাংশ বেশি।
চট্টগ্রাম বিভাগের মধ্যে ফটিকছড়িতেই রয়েছে সর্বাধিক ১৭টি চা বাগান। ২০২৪ সালে এই অঞ্চলে উৎপাদিত হয়েছে ১ কোটি ৮ লাখ কেজিরও বেশি চা। তবে চা শিল্পে নিযুক্ত দেড় লাখ শ্রমিকের অধিকাংশের জীবনমান রয়ে গেছে করুণ অবস্থায়।
বর্তমানে একজন চা শ্রমিকের দৈনিক মজুরি ১৭৮ টাকা। চলমান দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে এই মজুরি দিয়ে স্বাভাবিক জীবন যাপন সম্ভব নয়। চট্টগ্রামের নারায়ণহাটের নেপচুন বাগানের শ্রমিক তাহেরা বেগম বলেন, “এই টাকায় সংসার চলে না।” কইয়াছড়া চা বাগানের আনোয়ারা বেগম অভিযোগ করেন, “বৃষ্টিতে প্লাস্টিক দিয়ে শরীর ঢাকতে হয়, রেইনকোট দেওয়া হয় না।” অন্যদিকে, কর্ণফুলী বাগানের কৃষ্ণ মনি জানান, “৯টা থেকে ৫টা পর্যন্ত কাজ করি, দুপুরে বিশ্রামের সুযোগ নেই।”
২০২৫ সালের সংশোধিত শ্রম আইনে চা শ্রমিকদের জন্য দৈনিক মজুরি ২২০ টাকা নির্ধারণসহ স্বাস্থ্যসেবা, ঝুঁকিভাতা, আবাসন ও মাতৃত্বকালীন ছুটির বিধান রাখা হলেও বাস্তবায়ন হচ্ছে না। ২০১৫ সালের শ্রমবিধিমালার নির্দেশনায় প্রতিবছর ১০ শতাংশ ঘর পাকা করার কথা থাকলেও সেটিও বাস্তবায়িত হয়নি।
দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে চা শ্রমিকদের মজুরি সর্বনিম্ন। ভারতে একজন শ্রমিক দৈনিক পান প্রায় ২৪০ টাকা এবং শ্রীলঙ্কায় প্রায় ৬০০ টাকা। সেই সঙ্গে রয়েছে আবাসন ও চিকিৎসা সুবিধাও।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও ইউনিসেফের ২০১৮ সালের যৌথ জরিপে দেখা যায়, চা শ্রমিক পরিবারগুলোর ৭৪ শতাংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে, যেখানে জাতীয় গড় মাত্র ২৪ শতাংশ। ২০২৫ সালেও এই চিত্রে উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়নি, বরং দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে জীবন আরও দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বের নবম বৃহত্তম চা উৎপাদক দেশ। এই অর্জনের পেছনে যাদের ঘাম, শ্রম ও জীবন উৎসর্গ হয়েছে— সেই চা শ্রমিকদের জন্য এখন প্রয়োজন ন্যায্য মজুরি, মানবিক অধিকার এবং রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি।
শুধু প্রতিশ্রুতিতে নয়, প্রয়োজন শ্রমিকদের জীবনে টেকসই পরিবর্তন আনা। চা বোর্ড, শ্রম মন্ত্রণালয়, বাগান মালিক ও নাগরিক সমাজকে একযোগে বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে— তাহলেই চা দিবস হবে শ্রমিকদের জন্য সত্যিকার অর্থে তাৎপর্যপূর্ণ।
একুশে সংবাদ/ চ.প্র/এ.জে