অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। এ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ইতোমধ্যে আতঙ্কিত হয়ে উঠছে চট্টগ্রাম। সম্প্রতি রাউজান, রাঙ্গুনিয়া, ফটিকছড়ি, হাটহাজারীসহ পুরো চট্টগ্রাম জুড়ে খুনের মহোৎসব চলছে।
২০২৪ সালের ৩১ আগস্ট সন্ধ্যায় পাঁচলাইশ এলাকার কুয়াইশ রোডের নাহার গার্ডেন নামের একটি রেস্তোরাঁর সামনে হঠাৎ একটি অটোরিকশা লক্ষ্য করে গুলির ঘটনা ঘটে। রিকশায় থাকা আনিস ঘটনাস্থলেই মারা যান, অন্য যাত্রী মাসুদ আহত অবস্থায় পালিয়ে যান। কিছুক্ষণ পর দেড় কিলোমিটার দূরে নিজের বাড়ির সামনে মাসুদকেও গুলি করে হত্যা করা হয়।
একসময় চট্টগ্রামে প্রায়ই এমন টার্গেট কিলিং ঘটত। আবারও সেই পুরোনো ধারা ফিরে এসেছে। জানা গেছে, সরোয়ার হোসেন বাবলার বাড়ি থেকে মিটিং শেষে ফেরার পথে ওই দুইজনকে হত্যা করা হয়। ঘটনাটি নিয়ে দুই থানায় পৃথক দুটি মামলা হয়, যেখানে সাজ্জাদ হোসেনসহ চারজনের নাম উল্লেখ করা হয় এবং অজ্ঞাতনামা তিন-চারজনকে আসামি করা হয়।
সরোয়ার হোসেন ছিলেন আলোচিত ‘এইট মার্ডার’-এর প্রধান আসামি ও ‘শিবির ক্যাডার’ হিসেবে পরিচিত সাজ্জাদ হোসেন খান ও হাবীব খানের অনুসারী। পরবর্তীতে সাজ্জাদের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়ান সরোয়ার। তাকে শায়েস্তা করতে সাজ্জাদ খান আরেকজন সাজ্জাদকে দলে ভেড়ান, যিনি ‘ছোট সাজ্জাদ’ নামে পরিচিত হন।
গত ১৬ মাসে শুধু চট্টগ্রাম শহরেই ৬টি টার্গেট কিলিংয়ের ঘটনা ঘটেছে—যেখানে ভিকটিমদের অধিকাংশই সরোয়ার হোসেনের অনুসারী। ৫ নভেম্বর (বুধবার) সন্ধ্যায় নিজের ঘরের সামনে টার্গেট কিলিংয়ের শিকার হন সরোয়ার হোসেন বাবলা।
এর আগে গত বছরের ২১ অক্টোবর চান্দগাঁওয়ে মাইক্রোবাসে করে এসে আফতাব উদ্দিন তাহসিনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। চলতি বছরের ৩০ মার্চ বাকলিয়া এক্সেস রোডে সরোয়ারকে হত্যার চেষ্টা হয়, যেখানে তার দুই সহযোগী নিহত হন। ২৫ মে পতেঙ্গা এলাকায় সরোয়ারের আরেক অনুসারী ‘ঢাকাইয়া আকবর’কেও গুলি করে হত্যা করা হয়।
প্রতিটি ঘটনায় সাজ্জাদ হোসেন ও তার সহযোগী রায়হানের নাম ঘুরে-ফিরে এসেছে। পুলিশের ধারণা, একটি অঘোষিত গ্যাংওয়ার চলছে চট্টগ্রামে—যার পেছনে ভারতের পাঞ্জাবে অবস্থানরত সাবেক শিবির ক্যাডার সাজ্জাদ হোসেন খান মূল পরিকল্পনাকারী।
সাজ্জাদ হোসেন খানের দুই অনুসারী ছিলেন সরোয়ার ও ম্যাক্সন, দুজনই একসময় ছাত্রশিবিরের কর্মী ছিলেন। সাজ্জাদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে ১৭টি মামলা রয়েছে। বিদেশে বসেই তিনি চট্টগ্রামের বায়েজিদ এলাকার শিল্পপ্রতিষ্ঠান, মোটর পার্টসের দোকান ও নির্মাণ প্রকল্প থেকে চাঁদা আদায় করতেন।
২০২০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সরোয়ারকে আটক করে ইমিগ্রেশন পুলিশ। পরে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ তাকে নিয়ে অভিযান চালিয়ে একটি একে-২২ রাইফেল ও গুলি উদ্ধার করে। ২০২২ সালে রহস্যজনকভাবে কলকাতায় মারা যান ম্যাক্সন।
কারাগারে থাকাকালীন বিএনপি নেতা আসলাম চৌধুরীর সঙ্গে বাবলার ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়। মুক্তির পর তিনি চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক এরশাদ উল্লাহ ও দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক আবু সুফিয়ানের কাছাকাছি আসেন। মাত্র এক মাস আগে বাবলা বিয়ে করেন, যেখানে বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতারাও উপস্থিত ছিলেন। এরপর থেকেই তাকে রাজনৈতিক সভা-সমাবেশে দেখা যায়, এবং নিজেকে ‘জুলাই যোদ্ধা’ বলে পরিচয় দিতেন।
মৃত্যুর কয়েকদিন আগে এক সাক্ষাৎকারে সরোয়ার বলেন, “বড় সাজ্জাদ ভারতে বসে চট্টগ্রামে চাঁদাবাজি করছে। টোকাই পোলা নিয়োগ দিয়ে যখন-তখন হত্যা করছে। পুলিশ তাদের ধরে না। পুরো চট্টগ্রামে দুই সাজ্জাদ সন্ত্রাস করছে, আমি এর প্রতিবাদ করি বলে তারা আমাকে শত্রু মনে করছে।”
বুধবার রাতে এভারকেয়ার হাসপাতালে এরশাদ উল্লাহকে দেখতে গিয়ে সাংবাদিকদের সিএমপি কমিশনার হাসিব আজিজ বলেন, “টার্গেট ছিলেন সরোয়ার। তার অপরাধের ইতিহাস আছে। হামলার ইন্ধন দেশের বাইরে থেকেও আসছে।”
চট্টগ্রাম এখন আতঙ্কের নগরী। গত এক বছরে এখানে ৪৯টি খুন, রহস্যজনক মৃত্যু ও ক্ষতবিক্ষত মরদেহ উদ্ধারের ঘটনা ঘটেছে। সবশেষ নির্বাচনী প্রচারণায় বুধবারের হামলা নতুন করে অস্থিরতার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
রাজনৈতিক মহল বলছে, এই হত্যাকাণ্ডগুলো শুধুমাত্র আন্ডারওয়ার্ল্ডের দ্বন্দ্ব নয়; এর মাধ্যমে বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে দুর্বল করার বার্তাও দেওয়া হচ্ছে।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (উত্তর) উপপুলিশ কমিশনার আমিরুল ইসলাম জানান, “পরিবার অভিযোগ দিলে মামলা হিসেবে রেকর্ড করা হবে। অভিযুক্তদের ধরতে পুলিশ মাঠে কাজ করছে।”
একুশে সংবাদ/এ.জে



একুশে সংবাদের সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

