একটা ফুলের বাগানের মতো একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান—সেখানে আচমকা একটি আস্ত বিমান ভেঙে পড়ল। সেই বাগানের ছোট্ট ছোট্ট ফুলগুলোকে যেন কেউ হঠাৎ টেনে-ছিঁড়ে উপড়ে দিল।
আহতের চিৎকার শোনা যায়নি, কারণ তারা তো শিশু। যাদের স্কুলের জুতোর ফিতা মা-বাবাই বেঁধে দেন, টিফিনে খাবারটা যেন ঠিকমতো খায়—এই কথা যাদের প্রতিদিন মনে করিয়ে দিতে হয়। সেই কোমল প্রাণ শিশুরা এতটা যন্ত্রণা কীভাবে সহ্য করল?
আমি একজন শিক্ষক হিসেবে যখন শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করি, তখন আমার মনে হয়—প্রতিটি শিক্ষার্থী এক একটি ফুটন্ত গোলাপ, যারা শিক্ষা নামক আলো পেয়ে শুধু ফোটার অপেক্ষায়। আবার যখন তাদের সমস্যা নিয়ে অভিভাবকদের সঙ্গে কথা হয়, তখন বুঝতে পারি—পিতা-মাতা মানে শুধু সন্তানের জন্মদাতা নন, তারা মানে ত্যাগ, উৎসর্গ।
কিন্তু এ কেমন ত্যাগ, যেখানে কোনো দিন আর ‘বাবা’ বা ‘মা’ ডাক শোনা যাবে না?
এ কেমন জীবন, যেখানে প্রিয় সন্তানের মুখ আর কোনোদিন দেখা হবে না?
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে আহত শিশুদের রক্তাক্ত ছবিগুলো ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। কিছু মানুষ মোবাইল হাতে ছুটে গেছে শুধু ছবি তুলতে, ভিডিও করতে—ভিউ বাড়ানোর জন্য। হাসপাতাল কিংবা দুর্ঘটনাস্থলে দর্শনার্থীদের ভিড় দেখে প্রশ্ন জাগে, আমরা কী ধরনের সভ্যতায় বাস করি? যেখানে কেউ কষ্টে আছে দেখলে পাশে দাঁড়ানোর বদলে, কেউ কেবল তাকিয়ে থাকে!
শিশুদের পাশে থাকার নামে তাদের পোড়া দেহের ছবি ছড়িয়ে দেওয়ার মধ্যেও আছে অমানবিকতা, নির্মমতা।
আমরা এখন আনুষ্ঠানিকতা দিয়েই আবেগকে প্রকাশ করি। আর আবেগকে বানিয়ে ফেলেছি দেখানোর বস্তু।
কিন্তু এর শেষ কোথায়?
কখন বুঝব যে, চোখ খুলে দেখার সময় হয়তো ফুরিয়ে গেছে?
দেশের প্রতিটি শিশু আমার-আপনার সন্তান। আমরা সবাই মিলে তাদের জন্য কাজ করব, এটাই এখন সময়ের দাবি। কেবল বিলাপ নয়, আমাদের দায়িত্ব—আহতদের পাশে দাঁড়ানো, সহযোগিতা করা। যদি কিছু করতে না-ই পারি, অন্তত হৃদয় থেকে দোয়া করি—সৃষ্টিকর্তা যেন সব সময় আমাদের সন্তানদের নিরাপদে রাখেন।
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আদালত যদি হয় আমাদের বিবেক, তবে সেই আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আমাদের নিজেকেই জিজ্ঞাসা করা উচিত—কেন এমন ঘটনা ঘটল?
এই জায়গায় যদি আমার সন্তান থাকত, আমি কী করতাম?
মাহরীন চৌধুরী—একজন শিক্ষক, যিনি শিশুদের বাঁচাতে গিয়ে নিজেই নিঃশব্দে চলে গেলেন না-ফেরার দেশে।
তিনি দেখিয়ে গেছেন—এই শিশুরাই তাঁর সন্তান, আর তিনিই তাদের মা।
রক্তের সম্পর্কের চেয়ে বড় যে মানবিক দায়িত্ব, ভালোবাসা—তাঁর জীবন ও মৃত্যু আমাদের সেই শিক্ষাই দিয়ে গেল।
--- শরিফুল রোমান, শিক্ষক ও সংবাদ কর্মি
একুশে সংবাদ/এ.জে