AB Bank
  • ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন, ২০২৫, ১২ আষাঢ় ১৪৩২

সরকার নিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল

Ekushey Sangbad QR Code
BBS Cables
Janata Bank
  1. জাতীয়
  2. রাজনীতি
  3. সারাবাংলা
  4. আন্তর্জাতিক
  5. অর্থ-বাণিজ্য
  6. খেলাধুলা
  7. বিনোদন
  8. শিক্ষা
  9. তথ্য-প্রযুক্তি
  10. অপরাধ
  11. প্রবাস
  12. রাজধানী

দেনমোহর এবং সম্পত্তিতে বাংলাদেশের নারীদের প্রাপ্যতা ও বাস্তবতা


Ekushey Sangbad
ড. আলেয়া পারভীন
০২:১৩ পিএম, ২৬ জুন, ২০২৫

দেনমোহর এবং সম্পত্তিতে বাংলাদেশের নারীদের প্রাপ্যতা ও বাস্তবতা

বাংলাদেশে নারী-পুরুষ কর্তৃক ভোগকৃত মৌলিক অধিকারের মূল উৎস গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান হলেও জনগণের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় দুই ধরনের আইন কার্যকর রয়েছে: দেওয়ানি এবং ব্যক্তিগত। দেওয়ানি আইন সংবিধান প্রদত্ত নারীর অধিকার সংরক্ষণ করে এবং ব্যক্তিগত আইন পারিবারিক জীবনে নারীর অধিকার রক্ষা করে। একজন ব্যক্তি যে সম্প্রদায়ে জন্মগ্রহণ করেন, সেই ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ব্যক্তিগত আইন অনুযায়ী পারিবারিক আইনসমূহ পরিচালিত হয়।

বাংলাদেশের মুসলমানদের পারিবারিক জীবন ইসলামী শরীয়াহ আইন দ্বারা পরিচালিত হলেও, ঐতিহাসিক কারণে এবং বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় কোরআন ও হাদীসের মূল শিক্ষা অক্ষুণ্ন রেখেই বিভিন্ন সময়ে আইন সংশোধন, সংযোজন এবং পরিবর্তন হয়েছে। ব্যক্তিগত আইনের মধ্যে দেনমোহর, বিয়ে, বিবাহবিচ্ছেদ, ভরণপোষণ, অভিভাবকত্ব, সম্পত্তি ও উত্তরাধিকার প্রভৃতি বিষয় অন্তর্ভুক্ত।

সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন কর্তৃক দাখিলকৃত প্রতিবেদনে নারীর সম্পত্তিতে সমান অধিকার দাবির প্রেক্ষিতে যে প্রতিবাদ, সভা-সমাবেশ এবং সুশীল সমাজের মতবিনিময় দেখা গেছে, কিংবা সমাজচিন্তাবিদদের মধ্যে যারা বলে থাকেন, নারীরা পিতা-স্বামী-ভাইসহ অন্যান্য আত্মীয়দের নিকট থেকে অনেক সম্পত্তি পেয়ে থাকেন—তারই প্রেক্ষিতে আজকের আলোচনার অবতারণা।

মুসলিম বিয়েতে দেনমোহর:

মুসলিম বিয়ে একটি দেওয়ানি চুক্তি। এই চুক্তির ফলে স্ত্রী স্বামীর নিকট থেকে দেনমোহর পাওয়ার অধিকারী হন। দেনমোহর নারীর সম্মান, অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তার প্রতীক এবং এটি স্বামীর কাছে স্ত্রীর এক ধরনের বিশেষ অধিকার। ইসলামী আইনে দেনমোহর একটি নির্ধারিত অর্থ বা সম্পত্তি, যা স্বামী স্ত্রীর প্রতি বিয়ের বিনিময়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। এমনকি যেখানে প্রকাশ্যভাবে কোনো দেনমোহর ধার্য করা না হলেও, বিয়ের একটি আবশ্যিক ফল হিসেবে ইসলামিক আইন স্ত্রীর জন্য দেনমোহর নির্ধারণ করে।

দেনমোহর দুটি ভাগে বিভক্ত: ১. তাৎক্ষণিক দেনমোহর – যা চাওয়া মাত্র প্রদান করতে হয়। এ পরিশোধ না হলে স্ত্রী স্বামীর সঙ্গে বসবাসে অরাজি থাকতে পারেন। ২. বিলম্বিত দেনমোহর – যা বিয়ের পর কোনো এক সময়ে পরিশোধ করা যায়, তবে স্বামীর মৃত্যু বা বিবাহবিচ্ছেদের পর অবশ্যই পরিশোধযোগ্য।

দেনমোহর এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, স্ত্রী তা না পেলে আদালতে মামলা করতে পারেন। কোনো স্বামী জীবিত অবস্থায় দেনমোহর পরিশোধ না করলে, তা পরিশোধের দায়িত্ব পড়ে তার উত্তরাধিকারের উপর।

পিএইচডি গবেষণার আলোকে নারীর দেনমোহরের বাস্তবতা:

আমার পিএইচডি অভিসন্দর্ভ "মুসলিম পারিবারিক আইন ও নারীর অধিকার: বাংলাদেশের গ্রামীণ নারীর সচেতনতা অধ্যয়ন" (২০১৪) অনুসারে নারীরা দেনমোহর সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন। ৭৯.৩% নারী জানেন, দেনমোহর হলো স্বামীর প্রদত্ত এক বিশেষ আর্থিক অধিকার। নিরক্ষর (৮৫.৪%) এবং শিক্ষিত (৮৫.৭%) নারী উভয়ই এই বিষয়ে সচেতন। চাকরিজীবী নারীদের সচেতনতা শতভাগ।

তবে বাস্তবে এই অধিকার ভোগের হার কম।
জনাব মোঃ ফারুক হোসেনের ২০১২ সালের গবেষণায় দেখা যায়, ৬৩.৮% নারী দেনমোহর পাননি। আমার ২০১৪ সালের গবেষণাতেও কেবল ৩৫.১% নারী দেনমোহর পেয়েছেন। বয়স অনুযায়ী, ২০-২৯ বছরের ৪.৫% নারী এবং ষাটোর্ধ্ব ১৩.৬% নারী সম্পূর্ণ দেনমোহর পেয়েছেন। গৃহিণীদের মধ্যে দেনমোহর প্রাপ্তির হার তুলনামূলক বেশি হলেও, চাকরিজীবী নারীরা নামেমাত্র পেয়েছেন। ২৫% চাকরিজীবী নারী কেবল আংশিক পেয়েছেন, কেউই অর্ধেক বা সম্পূর্ণ দেনমোহর পাননি।

দেনমোহরের টাকা নারীর আর্থিক উন্নয়নে সাহায্য করেছে মাত্র ১৯% ক্ষেত্রে। দেনমোহর সাধারণত স্বামীরা দিতে চান না। অনেক স্বামী বাসর রাতে স্ত্রীকে দেনমোহর মাফ করতে বলেন। “দেনমোহর চাও নাকি আমাকে?” – এ ধরনের প্রশ্নের মুখে নারীরা মানসিক চাপে পড়ে দেনমোহর মাফ করতে বাধ্য হন। গবেষণায় দেখা গেছে, ৪৫% নারী দেনমোহর মাফ করেছেন এবং ২৭.৯% নারী বাসর রাতেই দেনমোহর মাফ করতে বাধ্য হয়েছেন।

স্বামীর মৃত্যুর পর দেনমোহর পাওয়ার অধিকার আছে, এ বিষয়ে জানেন ৬৩.৯% নারী এবং স্বামী অস্বীকার করলে মামলা করতে পারেন, জানেন ৭৮.৬% নারী। কিন্তু বেশিরভাগ নারী মামলা করেন না সংসার রক্ষার স্বার্থে।

সম্পত্তির ক্ষেত্রে নারীর অধিকার ও বাস্তবতা:

মুসলিম উত্তরাধিকার আইনে স্বামী মারা গেলে স্ত্রী সন্তান না থাকলে ৪ ভাগের ১ ভাগ এবং সন্তান থাকলে ৮ ভাগের ১ ভাগ সম্পত্তি পান। মৃত পিতার সম্পত্তিতে কন্যা সন্তান একা থাকলে ২ ভাগের ১ ভাগ এবং একাধিক মেয়ে থাকলে ৩ ভাগের ২ ভাগ ভাগ করে পায়। ছেলে-মেয়ের ক্ষেত্রে ছেলের ভাগ দ্বিগুণ।তবে বাস্তবতা ভিন্ন।
গবেষণায় দেখা গেছে:

কেবল ১৪% নারী জানেন স্বামীর সন্তান থাকলে ৮ ভাগের ১ ভাগ পাবে।

কেবল ৬.৮% নারী জানেন সন্তান না থাকলে ৪ ভাগের ১ ভাগ পাবে।

কেবল ১৮.৮% নারী স্বামীর সম্পত্তি পেয়েছেন, যেখানে নিরক্ষর নারীরা কিছুটা (২০.২%) পেলেও, শিক্ষিত (গ্র্যাজুয়েট+) নারীরা স্বামীর সম্পত্তি পাননি (০%)।

পিতার সম্পত্তি পেয়েছেন কেবল ২১.৪% নারী। শিক্ষিত নারীদের মধ্যে এই হার মাত্র ১২.৫%।

নারীরা জানেন যে পিতা জীবিত অবস্থায় ছেলে-মেয়েকে সমানভাবে সম্পত্তি দান করতে পারেন (৮৬%), কিন্তু সমাজিক ও পারিবারিক বাস্তবতায় তা হয় না। অনেকেই বলেন কোরআনে ১২ জন উত্তরাধিকারীর মধ্যে ৮ জনই নারী। কিন্তু বাস্তবে পিতা বা স্বামীই যখন সম্পত্তি দিতে অনিচ্ছুক, তখন ভাই বা অন্যান্য আত্মীয়দের থেকে সম্পত্তি পাওয়া প্রায় অসম্ভব।

সুপারিশ: দেনমোহর বিষয়ে: ১. স্বামীর আর্থিক সামর্থ্যের আলোকে দেনমোহরের পরিমাণ নির্ধারণ করে তাৎক্ষণিক কিছু অংশ এবং বাকি অংশ ১-২ বছরের মধ্যে বাধ্যতামূলক পরিশোধের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। ২. নির্ধারিত সময়েও পরিশোধ না হলে দেনমোহরের পরিমাণ সোনার বাজারদরের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পুনঃনির্ধারণ করতে হবে।

সম্পত্তি বিষয়ে: ১. পিতা ও স্বামী জীবদ্দশায় কন্যা ও স্ত্রীর নামে হেবা বা উইল করে দিতে পারেন। ২. নারীরা সম্পত্তি না পেলে বিনামূল্যে ও দ্রুত আইনি সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে।

পরিশেষে : বাংলাদেশের সংবিধান ও আইন নারীর দেনমোহর ও সম্পত্তির অধিকার নিশ্চিত করলেও বাস্তবতায় তা ভোগের চিত্র ভিন্ন। পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব, আত্মীয়দের চাপ, আইনি জ্ঞানের অভাব, মামলার ভয় এবং আর্থিক দুর্বলতার কারণে নারীরা তাদের এই অধিকার থেকে বঞ্চিত হন। অথচ এই অধিকার কেবল আইনগত নয়, বরং নারীর মানবাধিকার, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা এবং সামাজিক মর্যাদার প্রতীক। এই বাস্তবতা পরিবর্তনের জন্য সমাজের প্রতিটি স্তরের সচেতনতা ও সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রয়োজন।

 

ড. আলেয়া পারভীন,সহযোগী অধ্যাপক (রাষ্ট্রবিজ্ঞান)
সরকারি সংগীত কলেজ, ঢাকা

 

একুশে সংবাদ/এ.জে

Link copied!