AB Bank
  • ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ৩০ অক্টোবর, ২০২৫, ১৪ কার্তিক ১৪৩২

সরকার নিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল

Ekushey Sangbad QR Code
BBS Cables
Janata Bank
  1. জাতীয়
  2. রাজনীতি
  3. সারাবাংলা
  4. আন্তর্জাতিক
  5. অর্থ-বাণিজ্য
  6. খেলাধুলা
  7. বিনোদন
  8. শিক্ষা
  9. তথ্য-প্রযুক্তি
  10. অপরাধ
  11. প্রবাস
  12. রাজধানী

বিশ্ব পর্যটনের বাস্তবতায় বাংলাদেশের অবস্থান: সংকট ও উত্তরণের পথ


Ekushey Sangbad
একুশে সংবাদ ডেস্ক
১২:১২ পিএম, ৩০ অক্টোবর, ২০২৫

বিশ্ব পর্যটনের বাস্তবতায় বাংলাদেশের অবস্থান: সংকট ও উত্তরণের পথ

প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, নদী, পাহাড়, লোকজ ঐতিহ্য ও প্রাণবন্ত সংস্কৃতির দেশ আমাদের বাংলাদেশ। কিন্তু প্রশ্ন রয়ে গেছে—এত সম্ভাবনা থাকার পরও কেন আমরা পর্যটনে পিছিয়ে? এর একমাত্র উত্তর—চোখ থাকার পরও না দেখা।

বাংলাদেশে পর্যটন যেন এক অবহেলিত সম্ভাবনার নাম, যাকে গুরুত্বহীন করে রাখা হয়েছে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে, নীতিতে, পরিকল্পনায় এবং বাস্তবায়নে। কতটা বৈপরীত্যের বিষয়, আমরা জাহাজ রপ্তানি করি, সমুদ্রজয়ের গল্প শুনি; অথচ সেই দেশের পর্যটকরা সেন্টমার্টিন বা সুন্দরবনে যাওয়ার জন্য নিয়মিত ও নিরাপদ জাহাজ সার্ভিসের অপেক্ষায় থাকেন! দক্ষতা ও প্রযুক্তির অভাব নেই, অভাব কেবল সদিচ্ছা, সমন্বয় আর কার্যকর পরিকল্পনার।

আমাদের পর্যটন অবকাঠামোর দুরবস্থা এই আত্মবিরোধিতাকেই স্পষ্ট করে। প্রবাল দ্বীপে যেতে অনিয়মিত সার্ভিস, সুন্দরবনে পর্যটনের কোনো মানসম্পন্ন অপশন নেই—এসব শুধু প্রশাসনিক ব্যর্থতা নয়, বরং এক প্রাতিষ্ঠানিক উদাসীনতার প্রতিফলন।

নীতিহীনতা ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার ঘাটতি

সরকার আসে, যায়; উন্নয়নের গল্প পাল্টায়, বাজেটের অঙ্ক বদলায়; কিন্তু পর্যটন থেকে যায় এক পাশ কাটানো অনুচ্ছেদ হয়ে। দীর্ঘদিন ধরে এই খাতে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অনুপস্থিতি স্পষ্ট। পর্যটনকে এখনো কেবল বিনোদন হিসেবে দেখা হয়, উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে নয়। অথচ টেকসই পর্যটনের মাধ্যমে অর্থনীতি, সংস্কৃতি, পরিবেশ এবং কর্মসংস্থান—সবক্ষেত্রেই পরিবর্তন আনা সম্ভব।

পেশাগত কাঠামোর সংকট

দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন, ট্যুরিজম বোর্ড কিংবা বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে পর্যটন ও হসপিটালিটি বিষয়ে শিক্ষাগত যোগ্যতাসম্পন্ন কর্মকর্তার অভাব। প্রশাসনিক ব্যাকগ্রাউন্ডের কর্মকর্তাদের উপস্থিতি থাকলেও তাঁরা প্রায়ই এই খাতের মানবিক ও প্রযুক্তিগত চাহিদা অনুধাবন করতে পারেন না।

অন্যদিকে, এই খাতে কর্মরতদের জন্য নেই চাকরির নিশ্চয়তা, পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ বা ক্যারিয়ার গ্রোথের সুযোগ। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে হাজার হাজার শিক্ষার্থী ট্যুরিজম ও হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্টে পড়াশোনা করে বের হলেও তাদের জন্য নেই সরকারি কাঠামো, নেই মর্যাদাপূর্ণ কর্মক্ষেত্র। ফলে তরুণ প্রজন্মের আগ্রহ ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে যাচ্ছে।

স্বীকৃতির অভাব ও মূল্যবোধের ফাঁক

পর্যটনে যারা জীবন উৎসর্গ করেছেন, তাঁদের জন্য রাষ্ট্রীয় কোনো স্বীকৃতি নেই। আমাদের দেশে চলচ্চিত্র, সাহিত্য ও ক্রীড়ায় জাতীয় পুরস্কার থাকলেও পর্যটনে নেই কোনো পুরস্কার বা সম্মাননা। অথচ এই মানুষগুলোর ঘাম-শ্রমেই দাঁড়িয়ে আছে সম্ভাবনাময় একটি শিল্প। এটি শুধু অবহেলা নয়, এটি আমাদের জাতীয় মূল্যবোধের এক ভয়াবহ ফাঁক।

পরিকল্পনা ও তথ্যের অভাব

আমরা এখনো পর্যটনে একটি পূর্ণাঙ্গ মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করতে পারিনি। নেই কোনো নির্ভরযোগ্য রোডম্যাপ। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারদের মধ্যে নেই সমন্বয় বা দায়িত্ব ভাগের মানসিকতা। এমনকি পর্যটন সংক্রান্ত নির্ভুল তথ্যও আমাদের কাছে অনুপস্থিত—বিদেশি পর্যটকদের আগমনের উদ্দেশ্য, ব্যয়, অবস্থানকাল কিংবা প্রকৃত অর্থনৈতিক অবদান সম্পর্কে কোনো তথ্যভিত্তিক বিশ্লেষণ নেই।

একটি তথ্যহীন পরিকল্পনা মানে হলো অন্ধ দিকনির্দেশনা। উন্নত দেশগুলো যেখানে তথ্যকে উন্নয়নের প্রথম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে, আমরা সেখানে এখনো কাগুজে প্রতিবেদনেই আটকে আছি।

বিকেন্দ্রীকরণভিত্তিক উদ্যোগের প্রয়োজন

দেশব্যাপী পর্যটন কাঠামো গড়তে চাইলে প্রতিটি জেলায় ‘পর্যটন কর্মকর্তা’ পদ সৃষ্টি করা জরুরি। জেলা প্রশাসকের অধীনে থাকা এই পদ স্থানীয় পর্যায়ে তথ্য, গবেষণা ও উদ্যোগ সমন্বয়ের দায়িত্ব পালন করতে পারে। এভাবে বিকেন্দ্রীকরণভিত্তিক পর্যটন উন্নয়নের সূচনা সম্ভব হবে।

সচেতনতা, শিক্ষা ও কর্মসংস্থান

পর্যটন সচেতনতা তৈরির কাজটি শুরু করতে হবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকেই। স্কুল-কলেজ পর্যায়ে পর্যটন বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা গেলে নতুন প্রজন্ম ভ্রমণকে দায়িত্ব ও সংস্কৃতির অংশ হিসেবে দেখতে শিখবে।

একই সঙ্গে দরকার সরকারি চাকরিতে পর্যটন শিক্ষার্থীদের অন্তর্ভুক্তি, মর্যাদাপূর্ণ বেতন কাঠামো, ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ও ইনকিউবেশন সেন্টার—যেখানে তরুণরা নিজেদের অঞ্চলে উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ শুরু করতে পারে।

গবেষণার ব্যবহার ও আন্তর্জাতিক সংযোগ

দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পর্যটন নিয়ে যে গবেষণা চলছে, তা নীতিনির্ধারণে ব্যবহার হচ্ছে না। এখন সময় এসেছে একটি ‘জাতীয় পর্যটন জ্ঞানকেন্দ্র’ (National Tourism Knowledge Hub) গড়ে তোলার—যেখানে গবেষণা, উদ্ভাবন ও বাস্তব উন্নয়ন একসাথে কাজ করবে।

রুয়ান্ডা, মালদ্বীপ, থাইল্যান্ডের মতো দেশগুলোর অভিজ্ঞতা আমাদের জন্য হতে পারে অনুপ্রেরণার উৎস।

দুর্যোগ ও সংকট মোকাবিলার প্রস্তুতি

বৈশ্বিক মহামারি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা রাজনৈতিক অস্থিরতায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় পর্যটন খাত। অথচ আমাদের নেই কোনো দুর্যোগ-পরবর্তী পুনরুদ্ধার পরিকল্পনা। এখনই প্রয়োজন পর্যটন খাতে স্বতন্ত্র দুর্যোগ-ব্যবস্থাপনা কৌশল প্রণয়ন, যাতে প্রতিকূল সময়েও এ খাত টিকে থাকতে পারে।

শেষ কথা: অবহেলা নয়, আত্মপরিচয়ের পথ

যদি এখনই আমরা এই অবহেলার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে না আসি, তবে হারাব আমাদের সেন্টমার্টিনের প্রবাল, লোকসাহিত্যের পাথরখণ্ড, কিংবা ভবিষ্যতের এক বিশাল সম্ভাবনা।

পর্যটন কেবল একটি সেক্টর নয়—এটি একটি জাতির সংস্কৃতি, মর্যাদা ও অর্থনৈতিক মুক্তির প্রতিচ্ছবি। পরিবর্তনের সময় এখনই। দরকার কেবল সাহস, পরিকল্পনা, স্বপ্ন ও বাস্তবায়নের ইচ্ছা।

হয়তো এই লেখা অনেকের চোখ এড়িয়ে যাবে, কিন্তু আমি তবুও লিখছি—কারণ বিশ্বাস করি, শব্দের নিজস্ব এক শক্তি আছে। কেউ না কেউ একদিন থমকে ভাববেন—আমরা কি সত্যিই আমাদের পর্যটনের এই সম্ভাবনাকে অবহেলাই করে যাচ্ছি?

আমি আশাবাদী—পর্যটনের উন্নয়ন মানেই বাংলাদেশের আত্মপরিচয়ের পুনর্জাগরণ।

 

একুশে সংবাদ/এ.জে

Link copied!