জুলাই গণঅভ্যুত্থানের এক বছর পূর্ণ হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অনেক কিছু ঘটেছে, অনেক কিছু বদলেছে, আবার অনেক কিছু বদলায়নি। ইতিহাসের সেই উত্তাল ৩৬ দিনের আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে পতন ঘটেছিল একটি স্বৈরাচারী সরকারের। রক্ত, ঘাম, জীবন দিয়ে মানুষ আশা করেছিল এক নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থার—যেখানে থাকবে ন্যায়বিচার, মানবিক মর্যাদা ও গণতন্ত্রের পূর্ণ প্রতিষ্ঠা।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ও ইতিবাচক উদ্যোগ নিয়েছে, যেমন জাতিসংঘের গুমবিরোধী সনদে স্বাক্ষর, বিচার বিভাগে সংস্কারের উদ্যোগ, এবং জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ রূপরেখা তৈরির কাজ। এসব অবশ্যই অস্বীকার করার নয়।

তবে, বাস্তব পরিস্থিতি এতটা সরল বা আশাব্যঞ্জক নয়। এখনো দেশের বিভিন্ন স্থানে সুফি মাজার ও দরগাহে হামলার ঘটনা ঘটছে, যার অনেকটাই সরকারের ‘জিরো টলারেন্স’ ঘোষণার পরেও থেমে থাকেনি। বরগুনায় সাম্প্রতিক হামলা এই ব্যর্থতার প্রমাণ। একইভাবে হতাহত আন্দোলনকারীদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসন ব্যবস্থা যথাযথ নয়। শহীদদের একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকাও তৈরি হয়নি, যা সরকার ও প্রশাসনের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে প্রশ্ন তোলে। এক বছরের মাথায়ও এমন একটি মৌলিক কাজ অসম্পূর্ণ থাকা শুধু প্রশাসনিক ব্যর্থতা নয়, এটি রাজনৈতিক অগ্রাধিকার নির্ধারণেরও প্রতিফলন।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক হলো, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে এখনো আগের মতোই অনীহা, পক্ষপাতিত্ব ও দায় এড়ানোর প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ঢালাও মামলা, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, কারাগারে মৃত্যু কিংবা ভিন্নমতের দমন—এসব যেন পরিবর্তনের মাঝেও পুরনো দিনের ছায়া। ‘অধিকার’ ও ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’-এর মতো সংস্থার প্রতিবেদনও এসব অভিযোগের সত্যতা তুলে ধরছে। প্রশ্ন হলো, তাহলে কি এই সরকারও পূর্ববর্তী সরকারের মতোই দমনমূলক নীতির পুনরাবৃত্তি করছে? আমরা কি নেতৃত্ব বদলে রাষ্ট্রচরিত্র বদলের সুযোগ হারাচ্ছি?
আমার মনে হয়, একটি গণঅভ্যুত্থানের প্রকৃত প্রাপ্তি কেবল একটি সরকারের পতনে নয়, বরং রাষ্ট্রযন্ত্রের নৈতিক ও গঠনমূলক রূপান্তরে নিহিত। যদি আমরা এখনও সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ন্যায়বিচারের স্বপ্ন বাস্তব রূপে দেখতে না পাই, তাহলে জনগণের আত্মত্যাগ, রক্ত, আর কান্না—all for what? এই প্রশ্নটি আমাদের সবাইকে, বিশেষ করে অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্বকে গভীরভাবে ভাবতে হবে। অতীতের শাসকগোষ্ঠী যদি দমন-পীড়নের কারণে জনরোষে পতিত হয়ে থাকে, তাহলে বর্তমান সরকারকে অবশ্যই সেই পুরনো পথে না হেঁটে একটি মানবিক, গণতান্ত্রিক ও জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্র গঠনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে—তা না হলে ইতিহাস বড়ই নির্মমভাবে বিচার করে।
একুশে সংবাদ/এ.জে