বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় নতুন করে আলোচনায় এসেছে পিআর বা প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচন পদ্ধতি। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও জোটের পক্ষ থেকে এই পদ্ধতির পক্ষে ও বিপক্ষে যুক্তি তুলে ধরা হচ্ছে। তবে ইসলামী দলগুলোর জন্য এই মুহূর্তে পিআর পদ্ধতি গ্রহণের যৌক্তিকতা কতটুকু- সেটি খোলাসা করা জরুরি।
পিআর পদ্ধতির সম্ভাব্য ইফেক্ট
পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে প্রথমেই নিবন্ধিত ছোট দলগুলো সংসদে অংশগ্রহণের সুযোগ পাবে। ফলে বর্তমানে নামমাত্র অস্তিত্ব থাকা কথিত বামপন্থী দলগুলিও জাতে উঠবে। আর এই সুযোগটিই আওয়ামী লীগ তাদের পুরনো রাজনৈতিক কৌশল অনুযায়ী কাজে লাগাতে পারবে।
কারণ, পিআর পদ্ধতিতে এককভাবে ৫০% ভোট না পেলে সরকার গঠন সম্ভব হয় না। ফলে ছোট দলগুলোকে সাথে নিয়ে জোট সরকার গঠন করতে হয়। এতে করে আওয়ামী লীগ তাদের অনুগত বা সুবিধাভোগী দলগুলোকে নিয়ে সংসদে ফিরে আসার প্রবল সুযোগ পাবে।
নেতিবাচক দিকগুলো
পিআর বাস্তবায়িত হলে দেশকে এক নতুন ধরণের সংকটে ঠেলে দেওয়া হবে। বিশেষ করে ইসলামী দলগুলোর জন্য এতে সুদূরপ্রসারী ক্ষতির আশঙ্কা প্রবল।
১. নামমাত্র দলের উত্থান : নাম সর্বস্ব রাজনৈতিক দলগুলো পার্লামেন্টে প্রবেশ করে আইন প্রণয়ন ও সরকার গঠন প্রক্রিয়ায় অযাচিত প্রভাব বিস্তার করবে।
২. আমলাতান্ত্রিক একচ্ছত্রতা : বিদ্যমান আমলাতান্ত্রিকতা বা লালফিতার দৌরাত্ম্য আরও বেড়ে যাবে। প্রশাসন হয়ে পড়বে অপ্রতিরোধ্য।
৩. ইসলামী দলগুলোর ভবিষ্যৎ : পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনে জামানত বাজেয়াপ্তের শর্তে একাধিকবার হারলে সেই ব্যক্তি বা দল স্থানীয় বা জাতীয় নির্বাচনে আর অংশ নিতে পারবে না। ফলে ইসলামী রাজনীতির জন্য এটি মারাত্মক বাধা হয়ে দাঁড়াবে।
৪. নিবন্ধন বাতিলের ফাঁদ : কোনো দলের ২৫% প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হলে নির্বাচন কমিশন সেই দলের নিবন্ধন বাতিল করতে পারবে। ফলে অগোছালো বা দুর্বল ব্যবস্থাপনায় থাকা ইসলামী দলগুলো এই শর্তে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে থাকবে।
‘ধর্ম বনাম দল’ বাস্তবতা
অনেকে আশঙ্কা করছেন, পিআর হলে হিন্দু সম্প্রদায় দল গঠন করে সংসদে ২০-৩০ আসন নিয়ে নেবে। তাদের মাধ্যমে র’ (ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা) দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হবে। বাস্তবতা হলো- ধর্ম নয়, এই দেশে দল বড়। ৯২% মুসলমানের দেশে ইসলামি দলগুলো কখনোই এককভাবে খেলাফত কায়েম করতে পারেনি।
হিন্দুরা বরাবরই আওয়ামী লীগ, বিএনপি বা জাতীয় পার্টির সাথে থেকেছে। নতুন দল গড়লেও সে দল ভোটের সময় কাঙ্ক্ষিত সমর্থন পাবে না। অতীতে যেমন অনেক হিন্দু সাংসদ হয়েছেন, তেমনিভাবে ভবিষ্যতেও পুরনো দলের ছত্রছায়ায়ই থাকবেন।
ভোটের ন্যূনতম হার শর্ত
বিশ্বের অধিকাংশ দেশে পিআর পদ্ধতির শর্ত হিসেবে ন্যূনতম ভোটের হার নির্ধারিত আছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এটি ৫-১০%। এর কম ভোট পেলে কোনো দল আসন পায় না। কিন্তু বাংলাদেশে কিছু ‘বুদ্ধিজীবী নেতা’ ভুল তথ্য দিয়ে বলছেন- ১% ভোট পেলে ৩টি আসন পাওয়া যাবে। এই তথ্য বিভ্রান্তিকর এবং বাস্তবতা বিবর্জিত।
মূল উদ্দেশ্য : বিএনপি ঠেকানো
বর্তমানে একাত্তরের পরাজিত একটি চক্র এবং নাম সর্বস্ব ‘নূর’ ধরণের কিছু দল এবং ব্যক্তিরা বিএনপিকে ঠেকানোর ছকেই পিআর পদ্ধতির কথা বলছে। অথচ এই পদ্ধতির বাস্তবায়নে আওয়ামী লীগ পুনর্বাসনেরই পথ সুগম হবে। কারণ, তারা যেকোনোভাবে তাদের অনুগত দল বা ভোটব্যাংককে কাজে লাগিয়ে জোট সরকার গঠন করতে সক্ষম হবে।
এক প্রশ্ন : প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ নির্ধারণ কেন?
আলোচনায় প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সীমাবদ্ধ করার কথা ওঠেছে। প্রশ্ন হলো, শুধু প্রধানমন্ত্রীর কেন? মন্ত্রী, এমপি, উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউনিয়ন চেয়ারম্যানদেরও মেয়াদ ১০ বছর নির্ধারণের দাবি কেন উঠছে না? এটা কি বৈষম্য নয়?
পিআর পদ্ধতিকে নিয়ে যেসব শঙ্কা এবং সমস্যা সামনে এসেছে- তা একেবারেই অবান্তর নয়। বাস্তবিক অর্থে এই পদ্ধতি দেশে আরও বেশি রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা, দালালতন্ত্র এবং অনৈতিক জোট-সরকারের জন্ম দেবে। ইসলামী দলগুলোর অস্তিত্ব সংকট আরও প্রকট হবে।
যাদের সাথে নিয়ে ইসলামী দলগুলো পিআর পদ্ধতির কথা বলছে, এটি আসলে একটি সুপরিকল্পিত ফাঁদ। কারণ, এই পদ্ধতির অনেক প্রবক্তাই ইসলামী অনুশাসনে রাষ্ট্র পরিচালনা চায় না। বরং তাদের অনেকেই বিগত দিনের প্রকাশ্য ইসলামবিদ্বেষীদের চেয়েও একধাপ এগিয়ে। তারা ক্ষমতার মসনদে বসার জন্য আজ ইসলামী দলগুলোর সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক গড়লেও, সুযোগ পেলেই সেই সঙ্গীদের ছুঁড়ে ফেলতে এক মুহূর্ত দেরি করবে না।
তাই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে ভেবে দেখা উচিত- আমরা কি কাল কেটে কুমির আনছি না তো?
তাই সাময়িক সুবিধার লোভে পড়ে ইসলামপন্থীরা যেন নিজেদের অস্তিত্ব বিলুপ্তির ফাঁদে পা না দেয়। বরং ন্যূনতম ভোট হার, জামানত বাজেয়াপ্ত, নিবন্ধন বাতিলের মতো কঠোর সংস্কারের মাধ্যমে নির্বাচন ব্যবস্থা শুদ্ধ করা এবং জনমতের প্রকৃত প্রতিফলন ঘটানোর দিকেই মনোযোগ দেওয়া উচিত।
একুশে সংবাদ/চ.প্র/এ.জে