AB Bank
ঢাকা শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সরকার নিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল

Ekushey Sangbad
ekusheysangbad QR Code
BBS Cables
Janata Bank
  1. জাতীয়
  2. রাজনীতি
  3. সারাবাংলা
  4. আন্তর্জাতিক
  5. অর্থ-বাণিজ্য
  6. খেলাধুলা
  7. বিনোদন
  8. শিক্ষা
  9. তথ্য-প্রযুক্তি
  10. অপরাধ
  11. প্রবাস
  12. রাজধানী
সমাজ সংস্কৃতি

বাউল সম্প্রদায়ের সুরক্ষা রাষ্ট্রের দায়িত্ব


Ekushey Sangbad
নূরুননবী শান্ত
০১:১২ পিএম, ২৬ নভেম্বর, ২০২২
বাউল সম্প্রদায়ের সুরক্ষা রাষ্ট্রের দায়িত্ব

দেশের বাউল সম্প্রদায় বিপদাপন্ন। অনেক দিন ধরেই বাউল সম্প্রদায়ের ওপর হামলা চলছে দেশের বিভিন্ন এলাকায়। কোথাও তাদের মঞ্চ ভেঙে দেওয়া হচ্ছে; কোথাওবা কেটে দেওয়া হচ্ছে বাউল গুরুর চুল। কোথাও পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে বাউলের বাসস্থান ও বাদ্যযন্ত্র। শুধু গানের মধ্য দিয়ে সৃষ্টিকর্তা ও জগৎ সম্পর্কে প্রশ্ন এবং তার যৌক্তিক ব্যাখ্যা তুলে ধরার অপরাধে তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা ও গ্রেপ্তারের নজিরও এ দেশে তৈরি হয়েছে। কেন? বাউলের অপরাধ কী? বাউল পন্থা গ্রহণ করতে কারও ওপর কি বল প্রয়োগের উদাহরণ আছে? বাউল কি কারও কিছু কেড়ে খায়? না, কিছুই করে না। সব ধর্মের ঊর্ধ্বে মানুষের বড়ত্ব ঘোষণা করে বাউল। সেই বড়ত্বে কোনো অহংকার নেই। নিরহংকার না হয়ে বাউল পথে নামা সম্ভব নয়। নিজের অবনমিত অবস্থান প্রকাশ ও প্রচার করতে বাউলকে ভিক্ষায় নামতে হয়। বাউল নিঃস্ব, নির্লিপ্ত জীবনের সাধনা করে।

 

ধর্মাধর্মের বিভেদের বাইরে আত্ম-অনুসন্ধানে মগ্ন বাউল কারও ক্ষতির কারণ কখনও হয়েছে বলে জানা যায়নি। বাউল জীবন মানে হিংসা-বিদ্বেষ-কাম-কামনার ঊর্ধ্বে ‍‍`জ্যান্ত মরা‍‍` মানুষের স্থিরতা অর্জনের অধ্যবসায়। মরদেহ যেমন পার্থিব মোহমুক্ত, তেমনি মরদেহের আধ্যাত্মিকতা বাউল জীবনের লক্ষ্য। প্রকৃত বাউল মহাপ্রকৃতির অংশ। গান তাঁর জীবনযাপন করার উপায়।

 

বাউল গানের কারণে বাংলাদেশের মর্যাদাপূর্ণ পরিচয় আছে বিশ্ব পরিসরে। বাউল গানকে জাতিসংঘ বিশ্ব ঐতিহ্যের মর্যাদা প্রদান করেছে। সারা দুনিয়ার হাজারো পরিবর্তনশীল সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের (ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ) বৈচিত্র্যময় ধরন থেকে মাত্র ৪৩টি ঐতিহ্য চিহ্নিত করতে গিয়ে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা (ইউনেস্কো) বাউল গানকে অসাধারণ সৃষ্টি বলে আখ্যা দিয়েছে।

 

এই অসাধারণত্ব বংশপরম্পরায় তৈরি হয় না; গুরু-পরম্পরায় তৈরি হয়। মুসলমানের সন্তান মুসলমান হয়, হিন্দুর সন্তান হিন্দু। কিন্তু জন্মসূত্রে বাউল হওয়ার উপায় নেই। বাউল হয়ে উঠতে গুরুর পথ অনুসরণের কঠোর সাধনা করতে হয়। আত্মশুদ্ধির পথে ধ্যানস্থ হতে হয়। গুরুর দীক্ষা মেনে মৃত মানুষের মতো স্রষ্টার দরবারে লীন হওয়ার সাধ্য থাকলে তবেই বাউল হওয়া যায়। হাজার বছর ধরে এই ঐতিহ্য প্রতিষ্ঠা পেয়েছে এবং তা চলমান। প্রাচীনতম সাহিত্য নিদর্শন চর্যাপদেও বাউলের উল্লেখ আছে ‍‍`বাজিল‍‍` বা ‍‍`বাজুল‍‍` নামে। বাস্তবিক কারণেই বাউল গান বিশ্বসমাজে বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য; বিশ্বের অমূল্য সম্পদ; বাংলাদেশের পরিচয়-গৌরব। বাউলের ওপর হামলা তাই বিশ্ব ঐতিহ্যের ওপর হামলা। বাংলাদেশের জাতীয় সংস্কৃতির ওপর হামলা।

 

সংবিধানের ২৩ অনুচ্ছেদে বলা হচ্ছে, ‍‍`রাষ্ট্র জনগণের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার রক্ষণের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন এবং জাতীয় ভাষা, সাহিত্য ও শিল্পকলাসমূহের এমন পরিপোষণ ও উন্নয়নের ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন যাহাতে সর্বস্তরের জনগণ জাতীয় সংস্কৃতির সমৃদ্ধিতে অবদান রাখিবার ও অংশগ্রহণ করিবার সুযোগ লাভ করিতে পারেন।‍‍` দুর্ভাগ্যজনকভাবে এ দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য অরক্ষিত। বাউলরা ভীত-সন্ত্রস্ত। ২০১১ সালে রাজবাড়ীর পাংশায় সাধুসঙ্গে হামলা হয়েছিল। ষাটোর্ধ্ব ২৮ জন বাউলকে প্রহার করা হয়েছিল সেবার। তাঁদের চুল-দাড়ি কেটে দিয়ে বলপূর্বক তওবা করানো হয়েছিল। গুজব ছড়ানো হয়েছিল- তাঁরা ইসলামবিরোধী চর্চা করে! ধর্মীয় স্বাধীনতার বাংলাদেশে অমুসলমানের অধিকার আছে নিজের পথ ও বিশ্বাস লালনপালন করার। বাউলদেরও অধিকার আছে যাঁর যাঁর ঘরানার নীতিনিয়ম পালন করার। সাধুসঙ্গ বাউলদের সবচেয়ে পবিত্র সম্মিলন। গান ও জ্ঞান আলোচনার উৎসব। অপরের পবিত্রতার ওপর হামলা করা কোনো ধর্মের নীতি নয়। রাজবাড়ীর ঘটনার বিচার হয়নি। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে আপস-মীমাংসা হয়েছিল! বাউলরা কারও ওপর ক্ষোভ পোষণ করেন না। তবুও নির্বিরোধ বাউলদের ওপর প্রতিরোধহীন, প্রতিকারহীন সহিংস হামলার ক্রমিক উদাহরণের তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে। সর্বক্ষেত্রেই অজুহাত এই- তাঁদের আচার-আনুষ্ঠানিকতা ইসলামসম্মত নয়! এই সহিংস আধিপত্যবাদী ভ্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গির হাত থেকে বিশ্ব ঐতিহ্য বাউল গানকে রক্ষা করার কোনো কার্যকর কর্মসূচি না থাকায় বাউল সম্প্রদায় আজ বিপদাপন্ন।

 

কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার লাউবাড়িয়া গ্রামে বাউলদের সাধুসঙ্গে হামলা মোটেই বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ধারাবাহিক বাউল নিধনযজ্ঞের চরম পর্যায় এটি। সেখানে ৯০ বছর বয়স্ক সাধু থেকে শুরু করে লাঞ্ছিত করা হয়েছে সাধিকাদেরও। অনুনয়-বিনয় করেও রক্ষা পাননি সাধুসঙ্গে অংশগ্রহণকারীরা। অথচ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রত্যেক নাগরিক ও সম্প্রদায়ের আইনি অধিকার আছে সমবেত হওয়া, নিজ নিজ মতাদর্শিক আনুষ্ঠানিকতা পালন ও প্রচার করার। ভিন্নপথ, ভিন্নমত যতক্ষণ না রাষ্ট্র ও সমাজের কল্যাণের বদলে ক্ষতি করে, ততক্ষণ তার বিরুদ্ধাচরণ এবং তার ওপর সহিংস হামলা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য ভয়াবহ হুমকি। এমনকি বৈশ্বিক মহামারি কভিড-১৯ বাউল গানের ততটা ক্ষতি করতে পারেনি, যতটা করার চেষ্টা করছে আধিপত্যবাদী মৌলবাদী শক্তি। এ পরিস্থিতি একদিকে যেমন সামাজিক অসহিষুষ্ণতার বহিঃপ্রকাশ, আরেক দিকে বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সুরক্ষায় প্রাতিষ্ঠানিক অবহেলারও প্রমাণ।

 

পরিবর্তনশীল সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সুরক্ষাবিষয়ক ইউনেস্কো সনদ ২০০৩ অনুসারে প্রতিটি রাষ্ট্র ‍‍`নিজস্ব ভৌগোলিক সীমানার পরিবর্তনশীল সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে;‍‍` (১১-ক)। বাংলাদেশ এই সনদের শুধু স্বাক্ষরকারীই নয়; ২০২২ সাল থেকে ২০২৬ মেয়াদের জন্য এই সনদ বাস্তবায়ন কমিটির সদস্যও। এ দেশে বাউল সম্প্রদায়সহ যে কোনো ধর্মীয় কিংবা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য চর্চাকারী নাগরিকের সুরক্ষা প্রদানে রাষ্ট্র প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরা আশা করি, বাউল সম্প্রদায়ের ওপর সহিংস হামলার প্রতিকার বিধান করতে এবং বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতি সম্মানবোধসম্পন্ন সমাজ গড়ে তুলতে সরকার দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। আমরা বিশ্বাস করি, সহিষুষ্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠায় বাউল সম্প্রদায়ের অস্তিত্বগত গুরুত্ব সবাই উপলব্ধি করবে। শিকড়হীন উদ্ভিদের পক্ষে যেমন বাঁচা অসম্ভব; ঐতিহ্য-বিচ্ছিন্ন জাতিরও তেমনি ধ্বংস অনিবার্য। বাংলাদেশের উদার ধারার পরিচয়-চিহ্ন মুছে ফেলার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত সংস্কৃতির ঘাতকদের থামাতে হবে।

 

একুশে সংবাদ.কম/সল/জাহাঙ্গীর

Link copied!