AB Bank
  • ঢাকা
  • সোমবার, ০৩ নভেম্বর, ২০২৫, ১৭ কার্তিক ১৪৩২

সরকার নিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল

Ekushey Sangbad QR Code
BBS Cables
Janata Bank
  1. জাতীয়
  2. রাজনীতি
  3. সারাবাংলা
  4. আন্তর্জাতিক
  5. অর্থ-বাণিজ্য
  6. খেলাধুলা
  7. বিনোদন
  8. শিক্ষা
  9. তথ্য-প্রযুক্তি
  10. অপরাধ
  11. প্রবাস
  12. রাজধানী

মৌলভীবাজারে মণিপুরি তাঁতশিল্প টিকিয়ে রাখতে নকল শাড়ি ফ্যাক্টরি বন্ধের দাবি



মৌলভীবাজারে মণিপুরি তাঁতশিল্প টিকিয়ে রাখতে নকল শাড়ি ফ্যাক্টরি বন্ধের দাবি

দেশের মণিপুরীদের রাজধানী খ্যাত মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলা। মনিপুরি এক একটা ঘর মানেই এক একটি তাঁত শিল্পের ছোট কারখানা। কমলগঞ্জ উপজেলার আদমপুর, তিলকপুর, মাধবপুর এবং শ্রীমঙ্গল উপজেলার রামনগর মণিপুরি পাড়াসহ বিভিন্ন এলাকায় মণিপুরি সম্প্রদায়ের বসবাস। এসব এলাকার শতকরা ৯০ ভাগ মণিপুরী মহিলা ও পুরুষ তাঁত শিল্পের সঙ্গে জড়িত। 

বর্তমানে মণিপুরি জনগোষ্ঠীর তাঁতশিল্পীদের ২০০ বছরের ঐতিহ্য ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। সারাদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেও প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে অব্যাহত লোকসানে দুর্দিন নেমে এসেছে তাঁতিদের। টিকতে না পেরে অনেকে ছেড়েছেন এ পেশা। আবার বাপ-দাদার পেশা বলে অনেকেই এটি আগলে ধরে আছেন। এমন অবস্থায় আধুনিক পোশাক কারখানার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকাই চ্যালেঞ্জের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে তাঁতিদের। এ পেশায় জড়িত প্রায় পাঁচ হাজার মণিপুরি নারী কর্মহীন হয়ে পড়ার তীব্র আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। 

মণিপুরি তাঁতবস্ত্র তৈরির সঙ্গে সম্পৃক্ত এমন কয়েকজন জানান, তাদের জীবিকার এক সময়ের প্রধান এই অবলম্বন এবং কৃষ্টি-সংস্কৃতির পরিচায়ক ধ্বংসে একটি বিশেষ মহল জড়িত। তারা মণিপুরিদের আদলে নিম্নমানের কাঁচামাল ব্যবহার করে পণ্য তৈরি করে বাজারে ছেড়েছিল। বাজার থেকে নিজেদের মুনাফা লুফে নিয়ে তারা সরে পড়েছে। মানহীনতার দায় কাঁধে নিয়ে দুর্নাম আর ভোগান্তি বইতে হচ্ছে এখন মণিপুরিদের।

গত ২৫ অক্টোবর কমলগঞ্জের ভানুবিল মাঝেরগাঁও কমিউনিটিবেইজ পর্যটনকেন্দ্রে মণিপুরি হস্তশিল্পী ও স্থানীয় বাসিন্দারা সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে এ বিষয়ে সরকারের কাছে তাদের বিভিন্ন দাবি তুলে ধরেন।

মণিপুরী হস্তশিল্পের তাঁতী ও ব্যবসায়ীদের পক্ষে লিখিত বক্তব্যে কমলগঞ্জের আদমপুর বাজারের মণিপরি হ্যাণ্ডিক্রাফট এর সত্ত্বধিকারী আব্দুস সামাদ বলেন, ২০২২-২৩ সাল থেকে একটি কুচক্রী মহল কমলগঞ্জের আদমপুর বাজারে উইভিং ফ্যাক্টরি স্থাপন করে এবং কুড়িগ্রাম জেলার রৌমারীতে একই ধরণের কারখানা নির্মাণ করে মণিপুরি শাড়ির অনুকরণে নিম্নমানের কাপড় তৈরি করে কম দামে বাজারে ছাড়ে। বিশেষ করে রংপুর বিভাগের কুড়িগ্রাম জেলার রৌমারি উপজেলা, টাঙ্গাইল জেলার কটোরিয়া বাজার, ঢাকা, সিলেট, শ্রীমঙ্গলসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় পাইকারী ৯৫০ থেকে ১০০০ টাকায় নকল মণিপুরি শাড়ি বিক্রি হচ্ছে। বাংলাদেশের দুই জেলায় ফ্যাক্টরি থাকার সুবাধে বিভিন্ন ডিজাইনের অর্জিনাল মুনিপুরি শাড়ি ক্রয় করে তার রংপুর ফ্যাক্টরিতে নিয়ে নিম্ন মানের সুতা দিয়ে খুব অল্প দামে বাজারজাত করছে। ফলে তাদের আসল পণ্য দামের কারণে বাজার হারাতে থাকে। এক পর্যায়ে মানহীনতার দায় নিয়ে ধসে পড়ে তাদের এই পণ্যের বাজার। 

এসময় মণিপুরী হস্তশিল্পের তাঁতী ও ব্যবসায়ীরা সরকারের কাছে কয়েকটি দাবি জানান। দাবিগুলো হচ্ছে—নকল শাড়ি উৎপাদন ও বিক্রির বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থাসহ সকল নকল মণিপুরী উইভিং ফ্যাক্টিরি বন্ধ করা, আসল তাঁতপণ্যের জিআই সনদের সঠিক বাস্তবায়ন, তাঁতিদের প্রশিক্ষণ, ডিজাইন উন্নয়ন ও স্বল্পসুদে ঋণ সুবিধা দেওয়া, কমলগঞ্জের আদমপুর বাজারে মণিপুরি তাঁতপণ্য সার্টিফিকেশন ও প্রদর্শনী কেন্দ্র স্থাপন করা এবং বাজারে ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরের নজরদারি বৃদ্ধি করা।

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন আদমপুরবাজার ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সভাপতি জাহাঙ্গীর মুন্না রানা, কলাবতী শাড়ি তৈরি করে দেশব্যাপী সাড়া জাগানো রাধাবতী দেবী, ডা.  কায়াম উদ্দিন, মনিপুরি কবি সনাতন হামহাম, ব্যবসায়ী আব্দুস সামাদসহ অনেকেই।  

তবে এ বিষয়ে এর আগেও বিভিন্ন সময় প্রতিবাদে সোচ্চার ছিলেন এই জনগোষ্ঠীর দায়িত্বশীল ব্যক্তি ও সামাজিক সংগঠন। কিন্তু কোনো প্রতিকার পায়নি মণিপুরী তাঁতশিল্প সংশ্লিষ্টরা।

ভুক্তভোগীরা জানান, ভারতের মণিপুর রাজ্য থেকে এসে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার আদমপুর ইউনিয়নের ভানুবিল মাঝেরগাঁওসহ বিভিন্ন গ্রামে বসতি গড়ে তুলেছিলেন তাদের পূর্বজনরা। নিজেদের জীবন ও জীবিকার অন্যতম মাধ্যম এবং জাতিগত ঐতিহ্যের শৈল্পিক কাজকে শুরু থেকেই চর্চা করে আসছেন তারা। তাঁতশিল্পের বিনাশকে তারা তাদের জাতিগত পরিচয় বিলুপ্তির অশনিসংকেত হিসেবে বিবেচনা করছেন। এটিকে রক্ষায় তারা সরকারসহ দেশের সর্বস্তরর মানুষের সহায়তা প্রত্যাশা করেন। 

জানা যায়, মণিপুরি, খাসিয়া বা চাকমা, আদিবাসী গোষ্ঠীগুলো ঐতিহ্যগতভাবেই মাতৃতান্ত্রিক পরিবার প্রথার অনুসারী। এই আদিবাসী নারীরাই মূলত বংশ পরম্পরায় তাঁতবস্ত্রের মতো কুটির শিল্পের উদ্ভাবক ও মূল চালিকা শক্তি হিসেবে ধরে রেখেছেন ২০০ বছরের এই ঐতিহ্য। 

বর্তমানে দুর্দিন নেমে এসেছে এসব তাঁতবস্ত্রের বাজারে। স্থানীয় পর্যায়ে এর যেটুকু চাহিদা আছে তাকে পুঁজি করে কিছু কিছু পরিবার চলছে। মৌলভীবাজার অঞ্চলের অন্তত ৫ হাজার মণিপুরি নারী তাঁতবস্ত্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তারা বলছেন, বাজার না থাকায় নতুন প্রজন্ম স্বাভাবিকভাবেই এই ক্ষেত্র  থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করেছেন। এই খাত ধ্বংস হয়ে গেলে বর্তমানে এর সঙ্গে যুক্ত থাকা প্রায় ৫ হাজার নারী বেকার হয়ে যাবেন। 

আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জীবন ও জীবিকা নিয়ে কাজ করেন এমন অনেকেই বলছেন ২০০ বছরের বেশি সময় ধরে  মৌলভীবাজার তথা সিলেট অঞ্চলের এই ঐতিহ্যবাহী পণ্য বাজার মাতিয়েছে। আদিবাসী গোষ্ঠীর অন্যতম কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রও ছিল এটি। মণিপুরি তাঁতপণ্য দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশেও প্রশংসা কুড়িয়েছে। সম্প্রতি ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে নিবন্ধনও পেয়েছে। কিন্তু আধুনিক বাজারের উপযুক্ত করে এটিকে নতুন প্রজন্মের হাতে তুলে দেওয়ার কোনো পদক্ষেপ বা পরিকল্পনা দেখা যায়নি।

কমলগঞ্জের মাঝেরগাঁওয়ের কল্পনা দেবী ও গীতা দেবী জানান, এক সময় ভানুবিল, শনগাঁও, নয়াপত্তন, ভান্ডারিগাঁওসহ মণিপুরি অধ্যুষিত ১৪টি গ্রামের ঘরে ঘরে দিন-রাত তাঁত চালানোর শব্দ শোনা যেত। এখন তাঁত চালিয়ে সুতা লাগিয়ে, মজুর খাটিয়ে তৈরি করা শাড়ি আর কেউ করতে চায় না। তাঁত শিল্পের কারিগর অরুণা দেবী জানান, মণিপুরি তাঁতে একখানা মোটামুটি মানের শাড়ি বুননে দুজন নারীর কমপক্ষে ৫ থেকে ৬ দিন সময় লাগে। সুতাই লাগে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকার। সব মিলিয়ে একটা শাড়ির খরচ পড়ে দুই হাজার  থেকে আড়াই হাজার টাকার মধ্যে। পাইকারি ক্রেতারা সেটি ২০০ থেকে ৩০০ টাকা বেশি দিয়ে কিনে নেন। অন্যদিকে পলিয়েস্টার সুতা মিশিয়ে নকশা জাল করে মেশিনে উৎপাদিত শাড়িগুলো দেখতে তাদেরগুলোর মতো হলেও নিম্নমানের। ক্রেতার সামনে তাদের এক হাজার থেকে বারোশ টাকার শাড়ি মণিপুরিদের আড়াই হাজার থেকে তিন হাজার টাকা মূল্যের শাড়িকে পেছনে ফেলে দিচ্ছে। এতে করে ক্রেতা মান এবং তারা বাজার হারাচ্ছেন।

আদমপুর বাজারের মণিপরি হ্যাণ্ডিক্রাফট এর সত্ত্বাধিকারী আব্দুস সামাদ বলেন, মণিপুরি শাড়ি বাংলাদেশের গর্ব এবং সম্প্রতি এটি জিআই সনদ পেয়েছে। জি আই পণ্য নকল করে বিক্রি এবং বাজারজাত করা একটি অপরাধ। এর বিরুদ্ধে সরকার যথাযথভাবে আইন প্রয়োগ না করার কারণে বিভিন্ন স্থানে নকল ফ্যাক্টরি স্থাপন ও শাড়ি বিক্রি হচ্ছে। ফলে মণিপুরি জনগোষ্ঠীর দীর্ঘদিন ধরে তাঁতশিল্পীরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। অনেকে অব্যাহত লোকসানে পেশা ছেড়ে দিয়েছেন। বর্তমানে তাঁত শিল্পে নেমে এসেছে দুর্দিন। তাঁত শিল্প রক্ষায় উইভিং ফ্যাক্টরিসহ সকল নকল মনিপুরি শাড়ির কারখানা বন্ধ করে ভৌগোলিক সুরক্ষা আইন ২০১৩ এর কঠোর বাস্তবায়ন করতে হবে।

 

একুশে সংবাদ/এ.জে

সর্বোচ্চ পঠিত - সারাবাংলা

Link copied!