ময়মনসিংহের ভালুকার হবিরবাড়ি ইউনিয়ানের পাড়াগাঁও গ্রামে ঢুকতেই চোখে পড়ে এক ভিন্ন দৃশ্য—সারি সারি খেজুর গাছ, প্রতিটিতে ঝুলছে কাঁচা ও পাকা সৌদি খেজুরের কাঁদি। নীল পলিথিনে ঢাকা কাঁদিগুলো বাতাসে দুলছে, যেন মরুভূমির স্বপ্ন এসে বসেছে বাংলার মাটিতে। গাছের গন্ধ, কাঁদির রঙ ও কচি পাতার ফিসফিস শব্দ—সব মিলিয়ে এখানে দাঁড়িয়ে বোঝা যায়, বিদেশি ফলও কেমন করে হয়ে উঠতে পারে দেশের গর্ব।
ভাবুন তো—নীল আকাশ, সবুজ পাতা আর ঝুলে থাকা সোনালি সৌদি খেজুরের কাঁদি বাংলার ভালুকায় এমনই এক স্বপ্ন বুনেছেন মোতালেব।
এটা শুধু কৃষির সাফল্য নয়—এটা এক জীবন্ত স্বপ্নের গল্প!
আবদুল মোতালেব, সৌদি ফেরত এক যুবক, ২০০১ সালে বাড়ির আঙিনায় মাত্র ৭০ শতাংশ জমিতে খেজুরের বীজ বপন করে শুরু করেছিলেন তার যাত্রা। ১৯৯৮ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তিনি সৌদি আরবের একটি খেজুর বাগানে কাজ করেন। সেখান থেকেই সংগ্রহ করেন প্রায় ৩৫ কেজি বিভিন্ন জাতের খেজুরের বীজ—এগুলোর মধ্যে সৌদি আরবের আজোয়া, শুক্কারি, আম্বার, লিপজেল ও মরিয়ম জাতের দেখা মেলে।
প্রথমে ২৭৫টি চারা রোপণ করলেও মাত্র ৭টি গাছ ফলধারক হয়ে ওঠে। বাকিগুলো পুরুষ গাছ হওয়ায় কাটিং ও প্রজনন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ধীরে ধীরে বাগানকে সমৃদ্ধ করেন। আজ তার হাতে গড়া চারটি বাগানে রয়েছে প্রায় ২ হাজারের বেশি খেজুর গাছ, এর মধ্যে ২৫০ টি গাছে এ বছর খেজুর ধরেছে।
প্রথম কয়েক বছরে তেমন ফলন না আসায় হতাশাও ছিল, কিন্তু মোতালেব হাল ছাড়েননি। একে একে মাতৃগাছ বৃদ্ধি, মাচা তৈরী, বাগানের পরিচর্যা পানির ব্যবস্থা ও নিরাপত্তা প্রাচীর—সব কিছু করেছেন নিজের উপার্জিত টাকায়।
এখন প্রতিটি পূর্ণবয়স্ক গাছে বছরে ৫–১০টি কাঁদি হয়, ছোট গাছে প্রতিটি কাঁধিতে ৮-১০ কেজি আর বড় গাছে প্রতি কাঁদিতে পাওয়া যায় ২০–২৫ কেজি খেজুর।
আজুয়া বড় জাতের খেজুর প্রতি কেজি ৪ হাজার, আজুয়া ছোট জাত প্রতি কেজি ২ হাজার, লিপজল বড় প্রতি কেজি ৪ হাজার টাকা, আমবাগ প্রতি কেজি ২ হাজার টাকা, সুকারী ১ হাজার ৫শ টাকা, বরকি ১ হাজার ৫শ টাকা কেজি বিক্রি হয়। গাছের কাছে দাঁড়ালে শোনা যায় বাতাসে পাতার মৃদু সঙ্গীত, আর হাত বাড়ালেই ছুঁয়ে দেখা যায় সোনালি মিষ্টির থোকা।
চারা বিক্রিও লাভজনক— ছোট আকৃতির প্রতিটি চারা ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা এবং কাটিং করা ফলধারক চারা ১ লাখ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। বাজারে আজ এই খেজুর মানেই “প্রিমিয়াম” পণ্যের প্রতীক।
প্রতিবছর জুলাই মাসের ১০/১২ তারিখ হতে খেজুরের কাঁদি গাছ থেকে নামানো শুরু করবেন বিক্রির জন্য। ক্রেতারা বাড়ী থেকেই খেজুর কিনে নেয়। বর্তমানে তাঁর খেজুরবাগান থেকে বছরে ৫০ লাখ টাকার বেশি আয় হচ্ছে বলে দাবি করেছেন আবদুল মোতালেব।
খেজুর নামানোর সময় গাছের নিচে জমে থাকে মিষ্টি গন্ধ, যা দূর থেকেও নাকে এসে লাগে।
খেজুর শুধু সুস্বাদুই নয়, পুষ্টিগুণেও অনন্য—প্রচুর প্রাকৃতিক শর্করা, ফাইবার, পটাশিয়াম ও আয়রন থাকে এতে। শরীরের শক্তি যোগানো, হজমে সহায়তা এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে এটি কার্যকর।
মোতালেবের মতে, “এখানে উৎপাদিত খেজুর সৌদি খেজুরের চেয়ে মিষ্টি, আর সংরক্ষণে কোনো হিমাগারের প্রয়োজন হয় না—সারা বছর রাখা যায়।”
আবদুল মোতালেব বলেন, “আমি পড়ালেখা করি নাই। দেশেও কৃষিকাজ করি এবং সৌদি আরবে গিয়ে আমি কৃষিকাজ পাই। সেখানে খেজুরবাগানে কাজ করে খেজুর খেয়ে মনে হলো, যদি দেশে একবার এই খেজুর চাষ করতে পারি তাহলে জীবন সার্থক, আর বিদেশে যেতে হবে না। ২০০১ সালে বাড়িতে আসার সময় ৩৫ কেজি বীজ নিয়ে আসি, সেখান থেকে মাত্র ২৭৫টি গাছ তৈরি করা হয়। দীর্ঘ ১৮ বছর গবেষণা করে ৭টি মাতৃগাছ পাই, বাকিগুলো সব পুরুষ গাছ। পুরুষ গাছগুলো কেটে মাতৃগাছগুলো থেকে কাটিং করে চারা উৎপাদন শুরু করি।”
তিনি আরও বলেন, “এখন আমার বাগানের যে অবস্থা, তাতে আমার পরবর্তী চৌদ্দ পুরুষ বসে খাবে, আমার সন্তানদের আর কষ্ট করতে হবে না। বাগানে এখন শুধু মাতৃ গাছ আছে। আমাদের বাগানে উৎপাদিত খেজুর সৌদি খেজুরের চেয়েও মিষ্টি।”
"এক সময় স্ত্রী সন্তান নিয়ে মাটির ঘরে বসবাস করতেন। খেজুর বাগান হতে আয়কৃত টাকায় তিনি দ্বিতল বিল্ডিং বাড়ী করেছেন, ৬ বিঘা জমি ক্রয় করেছেন যার মূল্য বর্তমানে কোটি টাকার উপরে। একটি বাগান থেকে বর্তমানে ৪ টি বাগানে সম্প্রসারিত করেছেন। যে উদ্দেশ্যে বিদেশ হতে দেশে ফেরৎ এসেছিলেন তা তিনি সাফল্যের সাথে অর্জণ করতে পেরেছেন" - বলে জানান আবদুল মোতালেব।
মোতালেব বলেন, "আমার সাফল্যের জন্য আমার স্ত্রী মজিদা আক্তার সমান অংশীদার। সব সময় পাশে থেকে রাতদিন আমাকে সাহায্য করেছেন। আমার বড় ছেলে মোফাজ্জল সম্প্রতি প্রবাসে গিয়েছে আর ছোট ছেলে মিজান আরও দুটি খেজুর বাগান করেছেন। মিজান দেশী খেজুর গাছের সাথে বিদেশী গাছের ক্রস করে মিশ্র গাছ তৈরি করেছে যাথেকে অধিক রস পাওয়া যাবে।"
আবদুল মোতালেবের ছোট ছেলে অনার্স প্রথম বর্ষ পড়ুয়া মিজানুর রহমান বলেন, "২০২৩ সাল থেকে বাবার সঙ্গে খেজুরবাগানে কাজ শুরু করি। আমি খেজুর গাছে কাটিং করে নতুন চারা উৎপাদন কৌশল শিখেছি। এ ছাড়া দেশি ও সৌদি খেজুরগাছ ক্রস করে একটি জাত উদ্ভাবন করেছি, যেটি থেকে প্রচুর রস উৎপাদন সম্ভব।"
মোতালেবের খেজুর চাষ দেখে উদ্বুদ্ধ হয়ে এলাকার আরও অনেকে খেজুর বাগান করতে শুরু করেছেন। তাঁর বাগানে প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন এলাকা থেকে উদ্যোক্তারা গিয়ে প্রাসঙ্গিক বিষয়ে ধারণা নেন ও গাছের চারা কেনেন। মোতালেবের বাগানের পাশেই ২০০৮ সাল থেকে বাগান শুরু করেন আফাজ পাঠান। তিনি বলেন, "মোতালেবের কাছ থেকে চাষ প্রযুক্তি শিখে এখন চারটি স্থানে ১০ একরের বাগান করেছেন। বাগানগুলোয় ভালো ফলন হচ্ছে। বছরে ২০-৩০ লাখ টাকা আয় হচ্ছে। শিক্ষিত বেকার তরুণ-যুবকেরা এই খেজুরবাগান করে জীবন পাল্টে দিতে পারে।"
বাগানটিতে ঘুরতে আসা কবি ও সাংবাদিক সফিউল্লাহ আনসারী নামের এক ব্যক্তি বলেন, "এখানে উৎপাদিত খেজুরগুলো তুলনামূলকভাবে বড় ও খেতে সুস্বাদু। দেশের চাহিদা পূরণের জন্য সৌদি খেজুর আমদানি করতে হয়। কিন্তু দেশে এটি সম্প্রসারিত হলে আমদানি নির্ভরতা কমবে এবং কৃষকেরাও লাভবান হবেন।"
সৌদি খেজুর চাষের বিষয়ে পরামর্শ দেওয়ার কথা জানিয়েছেন ভালুকা উপজেলার অতিরিক্ত কৃষি কর্মকর্তা মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, "খেজুরে রোগবালাই খুব কম হয়। আমরা এমন উদ্যোক্তাদের নিয়মিতভাবে পরামর্শ দিয়ে থাকি। তবে সরাসরি কোনো প্রকল্পের মাধ্যমে খেজুরবাগানে আমরা কোনো সহযোগিতা দিতে পারি না। সরকারিভাবে প্রকল্প নিয়ে কৃষকদের প্রণোদনার আওতায় নিয়ে আসলে তাঁরা উপকৃত হবেন ও চাষি বৃদ্ধি পাবে।"
গত বুধবার (৬ আগস্ট) খেজুরবাগানটি দেখতে যান ময়মনসিংহের বিভাগীয় কমিশনার মোখতার আহমেদ। তিনি বলেন, "মোতালেব সৌদি আরবে চাকরি করতে গিয়ে সেখান থেকে প্রযুক্তিজ্ঞান নিয়ে দেশের মাটিতে চাষাবাদ শুরু করেন। সৌদি খেজুর চাষের সম্প্রসারণ ও প্রণোদনার মাধ্যমে উদ্যোক্তা তৈরির পরিকল্পনার বিষয়টি নিয়ে কেবিনেট মিটিংয়ে উত্থাপন করা হবে।"
একসময় মাটির ঘরে থাকা মোতালেব আজ কোটি টাকার সম্পদের মালিক।
তার গল্প শুধু কৃষি সাফল্যের নয়—এটি সাহস, ধৈর্য ও মাটির প্রেমের গল্প।
মরুর বুকে জন্ম নেওয়া খেজুর এখন বাংলাদেশের মাটিতে শুধু ফল নয়, জন্ম দিচ্ছে স্বপ্ন, সাহস আর সম্ভাবনার নতুন ইতিহাস।
একুশে সংবাদ/ম.প্র/এ.জে