বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে বর্তমানে অনেকেই আইসিটি (তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি) নির্ভর ক্যারিয়ার গড়ার দিকে ঝুঁকছেন। এই খাতে নিজের দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে কেউ কেউ ফ্রিল্যান্সার হিসেবে সফল হচ্ছেন, আবার কেউ কেউ স্বাধীনভাবে আয় করার পথ তৈরি করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করছেন। এমনই এক অনুকরণীয় উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন নীলফামারী সদরের ইটাখোলা ইউনিয়নের কানিয়ালখাতা গ্রামের সুমন মুখার্জী।
সাফল্যের এই যাত্রাপথ মোটেও মসৃণ ছিল না। বরং ছিল নানা বাধা ও চ্যালেঞ্জে ভরপুর। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেওয়া সুমনের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন তার বাবা। পাঁচ সদস্যের পরিবারে অভাব-অনটন ছিল নিত্যসঙ্গী। সেই অভাব দূর করতে এক সময় প্রতিনিয়ত চাকরির খোঁজে ছিলেন সুমন। ভাগ্য বদলাতে শুরু হয় একটি পুরনো কম্পিউটার দিয়ে। মাত্র তিন বছরের ব্যবধানে তার মাসিক আয় দাঁড়িয়েছে প্রায় এক থেকে দেড় লাখ টাকা। নিজেই প্রতিষ্ঠা করেছেন একটি স্টার্টআপ—‘রঙ তুলি’। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটিতে কর্মসংস্থান হয়েছে নীলফামারীর সাতজন তরুণ-তরুণীর।
গত বুধবার (৩০ জুলাই) নিজের গল্প তুলে ধরেন সুমন। জানান, সময়টা ছিল ২০১৫ সালের শেষের দিক। তখন সদ্য এসএসসি পাস করেছেন। এরপর ২০১৭ সালে এইচএসসি পাস করে এক বন্ধুর সঙ্গে ঢাকায় পাড়ি জমান। শুরু হয় চাকরির সন্ধান। প্রথমে একটি গার্মেন্টসে অল্প বেতনে কিছুদিন কাজ করেন। পরে একটি মার্কেটিং প্রতিষ্ঠানে যোগ দিলেও দুই মাস না যেতেই প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ হয়ে যায়। কভিড-১৯ মহামারির সময় ঢাকাছাড়া হয়ে ফিরে আসেন নীলফামারীতে।
সুমন বলেন, বিভিন্ন জায়গায় চাকরি করে বুঝে যান যে ৯টা-৫টার চাকরি তার জন্য নয়। ছোটবেলা থেকেই কিছু নিজে করার ইচ্ছা ছিল তার। এক সময় এলাকার এক শিক্ষকের কাছ থেকে ফ্রিল্যান্সিং সম্পর্কে জানতে পারেন। ইউটিউব ও গুগল ঘেঁটে ফ্রিল্যান্সিং সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা নেন, কিন্তু সঠিক গাইডলাইনের অভাবে অগ্রসর হতে পারছিলেন না।
এরপর ২০২২ সালে নীলফামারী সরকারি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে (টিটিসি) ছয় মাসব্যাপী গ্রাফিক ডিজাইনের ওপর কোর্স করেন। বলেন, “প্রতিদিন ক্লাসের রেকর্ড করা ভিডিও রাতেও দেখতাম। প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ ঘণ্টা সময় দিতাম। ছয় মাসে নিজেকে গড়ে তুলি।” এরপর ফাইভারে অ্যাকাউন্ট খোলেন এবং ক্লায়েন্টদের মেসেজ দিতে থাকেন। ১৭ দিন পর স্পেনের এক ক্লায়েন্টের কাছ থেকে প্রথম পাঁচ ডলারের একটি কাজ পান। সময়মতো কাজ বুঝিয়ে দেওয়ায় সেই ক্লায়েন্ট বাড়তি পাঁচ ডলার টিপস দেন।
এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি সুমনকে। বর্তমানে তিনি প্রতি মাসে গড়ে ১ হাজার থেকে দেড় হাজার মার্কিন ডলার আয় করছেন। তিন বছরে তিনি সফলভাবে এক হাজারের বেশি প্রজেক্ট সম্পন্ন করেছেন। তার ক্লায়েন্টরা আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্স, স্পেন, ইতালি, রাশিয়া, সুইডেন, ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ডসসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে। তিনি বর্তমানে ‘টপ রেটেড নমিনি’ ফ্রিল্যান্সার হিসেবে ফাইভারে কাজ করছেন।
নিজের সাফল্যের পেছনে মূলমন্ত্র কী ছিল—এমন প্রশ্নের জবাবে সুমন এক কথায় বলেন, "ব্যর্থতা।" জানান, “শুরু থেকেই পরিবারের সহযোগিতা পেয়েছি। জীবনে অনেক বড় হতে চাই। কাজ করতে চাই আমার এলাকার তরুণদের নিয়ে। নিজের প্রতিষ্ঠানকে আরও বড় করতে চাই।”
নতুনদের জন্য পরামর্শ দিতে গিয়ে সুমন বলেন, “বর্তমান বাজারে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে কাজের অভিজ্ঞতা। আর অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য দরকার কাজ। এই চক্র ভাঙতে হলে শুরুতে ফ্রিতে কাজ করতে হবে। এর মাধ্যমে যেমন অভিজ্ঞতা হবে, তেমনি নিজের দক্ষতাও বাড়বে। কাজের পরিধি বাড়বে, পোর্টফোলিও তৈরি হবে এবং ভবিষ্যতে ভালো ক্লায়েন্ট পেতে সুবিধা হবে।”
একুশে সংবাদ/নী.প্র/এ.জে