জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার মহেশপুর গ্রামে প্রাচীনকাল থেকে টিকে থাকা ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প আজ বিলুপ্তির মুখে। বংশপরম্পরায় গড়ে ওঠা এই শিল্প আজকের দিনে এসে হারাতে বসেছে তার জৌলুস। সময়ের পালাবদলে এবং আধুনিক সভ্যতার ছোঁয়ায়,কুমারপাড়ার নারী-পুরুষেরা আর আগের মতো মাটির শিল্পে ব্যস্ত সময় কাটান না। অথচ কয়েক বছর আগেও তাদের নিপুণ হাতে গড়া মাটির তৈজসপত্রের কদর ছিল সর্বত্র। দৈনন্দিন জীবনের নানা কাজে এবং বাঙালির বিভিন্ন উৎসবে মাটির জিনিসপত্র ছিল অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ।
বাঙালির গায়ে হলুদ,সুন্নতে খাৎনা,বিয়ে,জন্মদিন, অন্নপ্রাশন,নবান্ন,পহেলা বৈশাখ কিংবা পহেলা ফাল্গুনের মতো গুরুত্বপূর্ণ আয়োজনে ব্যবহৃত হতো এসব মাটির তৈজসপত্র। তবে এখন সময়ের পরিবর্তনে প্লাস্টিক ,সিরামিক, সিনথেটিক,ধাতব, কাচ ও ম্যালামাইনের আধিপত্যে মাটির সামগ্রীর কদর অনেক কমে গেছে। তার উপর ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের প্রতি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাব মিলে মৃৎশিল্প আজ অস্তিত্ব সংকটে।
সরেজমিনে মহেশপুর গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, এ গ্রামের একমাত্র কুমারপাড়ার গুটিকয়েক শিল্পীই এখনো মাটির জিনিসপত্র তৈরির কাজের সাথে যুক্ত রয়েছেন। একসময় যেখানে পুরো পাড়া মৃৎশিল্পের জন্য বিখ্যাত ছিল, আজ সেখানে শিল্পীদের অনেকেই পেশা বদল করতে বাধ্য হচ্ছেন। কারণ, আগের মতো আর চাহিদা নেই, আয়ও নেই। সন্তানদের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে অনেকেই চান না তাদের ছেলে-মেয়েরা এই পেশায় আসুক। বরং সবাই চেষ্টা করছেন তাদের উচ্চশিক্ষিত করে ভালো চাকরির পথে চালিত করতে।
তবে সব সংকটের মাঝেও মহেশপুর গ্রামে প্রায় ৪০টি কুমার পরিবার এখনো বাপ-দাদার পেশাকে আঁকড়ে ধরে রেখেছেন। তবুও বাস্তবতার কঠিন চাপ দিন দিন বেড়েই চলেছে।
প্রবীণ মৃৎশিল্পী শ্রী সুনীল চন্দ্র পাল বলেন, ছোটবেলা থেকে বাবার সাথে থেকে মাটির জিনিস বানানো শিখেছি। আগে এগুলোর প্রচুর চাহিদা ছিল। এখন সেই দিন আর নেই। মাটির কাজ করতে খরচ অনেক বেশি। সরকার যদি মাসিক ভাতা ও সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করতো, তাহলে হয়তো আমরা এই পেশায় আরও ভালোভাবে টিকে থাকতে পারতাম।"
এছাড়া প্রবীণ শিল্পী গুরুচরণ পাল বলেন, বাপ- দাদার এই পেশা ধরে রাখতে গিয়ে অনেক কষ্ট করতে হচ্ছে। সবকিছুর দাম বেড়ে গেছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া এই পেশা টিকিয়ে রাখা অসম্ভব।"
শ্রী নীরেন চন্দ্র পাল বলেন,"আগে পুকুরের মাটি দিয়ে কাজ করতাম,এখন মাটি-বালু কিনে আনতে হয়। রঙের দামও বেশি। ফলে লাভের মুখ দেখা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কালাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শামিমা আক্তার জাহান বলেন,"লোকজ সংস্কৃতি রক্ষা এবং মৃৎশিল্পীদের পাশে দাঁড়ানো আমাদের দায়িত্ব। আমরা সৃজনশীল ও দৃষ্টিনন্দন কাজের জন্য প্রশিক্ষণ, প্রদর্শনী ও মেলার আয়োজনের মাধ্যমে মৃৎশিল্পের বাজার সম্প্রসারণে কাজ করবো। এতে করে গ্রামীণ অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখার পাশাপাশি বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যও সংরক্ষিত থাকবে।"
মহেশপুরের মৃৎশিল্প শুধু পেশা নয়, এটি একটি জীবন্ত ইতিহাস। এ শিল্প টিকিয়ে রাখতে হলে প্রয়োজন সময়োপযোগী সরকারি সহায়তা ও আধুনিক বিপণন ব্যবস্থার সংযুক্তি। না হলে হারিয়ে যাবে এক সমৃদ্ধশালী সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বড় এক ক্ষতি হয়ে থাকবে।
একুশে সংবাদ//কা.জ.প্র//এ.জে



একুশে সংবাদের সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

