AB Bank
  • ঢাকা
  • শনিবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৫, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩২

সরকার নিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল

Ekushey Sangbad QR Code
BBS Cables
Janata Bank
  1. জাতীয়
  2. রাজনীতি
  3. সারাবাংলা
  4. আন্তর্জাতিক
  5. অর্থ-বাণিজ্য
  6. খেলাধুলা
  7. বিনোদন
  8. শিক্ষা
  9. তথ্য-প্রযুক্তি
  10. অপরাধ
  11. প্রবাস
  12. রাজধানী

বারবার ভূমিকম্পে কাঁপছে দেশ, আরও বড় বিপর্যয় কি অপেক্ষা করছে?


Ekushey Sangbad
একুশে সংবাদ ডেস্ক
০৮:৩৩ পিএম, ২২ নভেম্বর, ২০২৫

বারবার ভূমিকম্পে কাঁপছে দেশ, আরও বড় বিপর্যয় কি অপেক্ষা করছে?

দেশজুড়ে গত ৩০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হানে ২১ নভেম্বর ২০২৫ সকালে। রিখটার স্কেলে কম্পনের মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৭, কেন্দ্র ছিল নরসিংদীর মাধবদী। এরপরও ভূমিকম্প থামেনি—২২ নভেম্বর সকালে বাইপাইলে ৩ দশমিক ৩ মাত্রা ও সন্ধ্যায় আবার ৪ দশমিক ৩ মাত্রার কম্পন অনুভূত হয়।

২১ নভেম্বরের শক্তিশালী কম্পনে হঠাৎ ধাক্কায় মানুষ ভবন ছেড়ে রাস্তায় নেমে আসে, কেউ কেউ প্রাণ বাঁচাতে লাফিয়ে পড়েন। রাজধানীসহ বিভিন্ন এলাকায় অসংখ্য ভবনে ফাটল দেখা দিয়েছে; অনেক ভবন হেলে পড়েছে।

গাজীপুর শিল্পাঞ্চলে শতাধিক শ্রমিক আহত হন। গাজীপুর মেট্রোপলিটনসহ সব উপজেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। কুমিল্লা ইপিজেডে আতঙ্কে অজ্ঞান হয়ে যান বহু শ্রমিক। ভূমিকম্প স্বরূপের ভয়াবহতা সবাইকে নতুন করে কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়।

পরিস্থিতি মোকাবিলায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর জরুরি কন্ট্রোল রুম চালু করেছে। বহু বছর ধরেই বিশেষজ্ঞরা বড় ধরনের ভূমিকম্পের সতর্কবার্তা দিয়ে আসছেন। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়—রাষ্ট্র আদৌ প্রস্তুত কি না? রাষ্ট্রীয় উদাসীনতা, দুর্নীতি এবং জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রতি কম দায়বদ্ধতা—সব মিলিয়ে ঢাকাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে ভয়াবহ বিপন্নতা তৈরি করেছে।

অপরিকল্পিত ও নিয়ন্ত্রণহীন নগরায়নে বাড়ছে ভূমিকম্পের ঝুঁকি

বাংলাদেশ ভূকম্পীয়ভাবে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল। বিশেষ করে ঢাকা—চরম জনঘনত্ব, দুর্বল অবকাঠামো এবং নিয়ন্ত্রণহীন নগর বিস্তারের কারণে এখানে ঝুঁকি বহুগুণ বেশি। প্রায় ২ কোটি মানুষের এক বড় অংশ বাস করেন দুর্বল, অপরিকল্পিত, সেমি-পাকা বা অনানুষ্ঠানিক আবাসনে—যেগুলো ভূমিকম্পে সহজেই ধসে যেতে পারে।

গত কয়েক দশকে ঢাকার বিস্তার ঘটেছে নিম্নাঞ্চল, জলাশয় ও জলাধার ভরাট করে। এসব এলাকায় কোনো ধরনের ভূতাত্ত্বিক সমীক্ষা ছাড়াই দালানকোঠা নির্মিত হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বহুদিন ধরেই বলছেন—বড় আকারের ভূমিকম্পের সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু সেই সম্ভাব্য বিপর্যয় ঠেকাতে রাষ্ট্রীয় প্রস্তুতি কতটুকু, তা নিয়ে প্রশ্ন ক্রমশই বড় হচ্ছে।

ঢাকার পূর্ব, দক্ষিণ-পশ্চিম এবং জলাশয়ভিত্তিক নতুন আবাসন প্রকল্পগুলো বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ। বড় ভূমিকম্প হলে এসব এলাকায় ব্যাপক ধস, প্রাণহানি ও অবকাঠামো ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। ঢাকার অর্ধেকের বেশি এলাকা এখন উচ্চঝুঁকির আওতায়।

চিলি, হাইতি ও তুরস্ক—তাদের অভিজ্ঞতা আমাদের সতর্কবার্তা

২০১০ সালে চিলির ৮.৮ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্পে প্রায় ৭০০ মানুষের মৃত্যু হয়। একই বছরে হাইতির ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে প্রাণ হারান প্রায় ২ লাখ মানুষ। পার্থক্যের মূল কারণ—চিলিতে কঠোর বিল্ডিং কোড ছিল এবং তা বাস্তবায়িত হয়; হাইতিতে ছিল না কোনো কার্যকর নির্মাণমান বা তদারকি।

২০২৩ সালে তুরস্ক-সিরিয়ার ৭.৮ মাত্রার ভূমিকম্পে ৫০ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু এবং ১.৬ লাখ ভবন বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনা দেখিয়ে দেয়—পরিকল্পনাহীন নগরায়ন, দুর্বল তদারকি ও নিম্নমানের নির্মাণ ব্যয়বহুল বিপর্যয় ডেকে আনে। তুরস্কের সেই বাস্তবতা ঢাকার উন্নয়নপদ্ধতির সঙ্গেও ভয়ংকরভাবে মিলে যায়।

ঢাকার ঝুঁকির নির্মম চিত্র

রাজউকের এক সমীক্ষা মতে, মধুপুর ফল্টে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকায় লক্ষাধিক ভবন ধসে পড়তে পারে। দিনের বেলা এমন ঘটনা ঘটলে কয়েক লাখ মানুষের প্রাণহানির আশঙ্কা রয়েছে।

২০১৮ সালের আরেক জরিপে দেখা যায়—ঢাকার জরিপকৃত ১.৯৫ লাখ ভবনের ৬৭ শতাংশই বিল্ডিং কোড লঙ্ঘন করে নির্মিত। সরকারি সংস্থার অধীনে থাকা অন্তত ৩৪২টি ভবন ‘অতি ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে চিহ্নিত হলেও কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বিপজ্জনক ভবন খালি করতে মালিকদের অনীহা এবং তদারকি সংস্থার দুর্বল অবস্থান পরিস্থিতিকে আরও গুরুতর করে তুলছে।

আইন আছে, প্রয়োগ নেই

ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি ২০২০), ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ২০০৮ এবং ড্যাপসহ একাধিক নীতি ও পরিকল্পনা থাকলেও এর বাস্তবায়ন অত্যন্ত দুর্বল। রাজনৈতিক প্রভাব, দুর্নীতি, তদারকি কাঠামোর দুর্বলতা এবং জবাবদিহি-সংকট—সব মিলিয়ে এসব বিধানের কার্যকারিতা প্রায় নেই বললেই চলে।

ভবন নির্মাণ অনুমোদনে ‘পরিকল্পনা অনুমোদন’ এখনো কার্যকর হয়নি—যা নগর পরিকল্পনার একটি মৌলিক শর্ত। ফলে বহু এলাকায় মানদণ্ডহীনভাবে ভবন গড়ে উঠছে।

সম্প্রতি অনুমোদন প্রক্রিয়ায় কাঠামোগত, স্থাপত্য, অগ্নি-নিরাপত্তা ও বৈদ্যুতিক-প্রকৌশল নকশা জমা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে—যা ইতিবাচক উদ্যোগ। তবে যথাযথ তদারকি ছাড়া এগুলোও কার্যকর হবে না।

করণীয় কী?

১. ক্ষয়ক্ষতি কমাতে বিল্ডিং কোড কঠোরভাবে বাস্তবায়ন
– ভবন নির্মাণে নিয়মভঙ্গের শাস্তি নিশ্চিত করা এবং বিল্ডিং রেগুলেটরি অথরিটি দ্রুত কার্যকর করা।

২. নিম্নাঞ্চল ও জলাধার ভরাট করে নির্মাণ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা
– পানি ধারণক্ষম এলাকা রক্ষা করা।

৩. ঝুঁকিপূর্ণ ভবন উচ্ছেদ ও তালিকা প্রকাশ
– রাজউক ও স্থানীয় প্রশাসনের তালিকাভুক্ত ভবনগুলো জরুরি ভিত্তিতে খালি করা।

৪. ভূতাত্ত্বিক সমীক্ষা বাধ্যতামূলক করা
– মাটির পরীক্ষা ও অন্যান্য ভূতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ ছাড়া কোনো বহুতল ভবনের অনুমোদন নয়।

৫. নাগরিক সচেতনতা বৃদ্ধি
– প্রশিক্ষণ, ড্রিল ও দুর্যোগ প্রস্তুতি শিক্ষাকে নিয়মিত করা।

৬. দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা
– অনিয়মে জড়িত প্রতিষ্ঠান ও কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা।

ঢাকা প্রতিদিন লক্ষাধিক মানুষের কর্মযাত্রা, বাসস্থান, শিক্ষা ও পরিবহনের কেন্দ্র। বড় কোনো ভূমিকম্প হলে শুধু ভবনই ভেঙে পড়বে না—অচল হয়ে যাবে রাস্তা, হাসপাতাল, বিদ্যুৎ-পানি, জরুরি সেবা—যা উদ্ধারকাজকে গুরুতরভাবে বাধাগ্রস্ত করবে।

এখনই বিল্ডিং কোড অনুসরণ, নগর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ এবং নাগরিক নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার না দিলে কোনো সতর্ক সংকেতই আমাদের রক্ষা করবে না।

ভূমিকম্প থামানো আমাদের হাতে নেই—কিন্তু প্রস্তুতি নেওয়া রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব। এ দায়িত্বে শিথিলতা মানে ভবিষ্যতের মৃত্যুমিছিল নিশ্চিত করা।

 

একুশে সংবাদ//এ.জে

Link copied!