গত ২৫ এপ্রিল রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় গ্যাসের গন্ধ ছড়িয়ে পড়লের আতঙ্কিত হন নগরবাসী। এপর গত ২৭এপ্রিল নারায়ণগঞ্জে তিতাস গ্যাসের পাইপলাইন লিকেজ হয়ে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। এতে পুরো এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। শুধু এ ঘটনা দুটি নয় প্রায়ই রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় গ্যাসের পাইপলাইন লিকেজ খবর শোনা যায়।
তিতাস গ্যাস সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তিতাস গ্যাসের বেশিরভাগ পাইপলাইনের টেকনিক্যাল টাইম ১৯থেকে ২০ বছর আগে শেষ হয়েছে। একারণে মেয়াদোত্তীর্ণ পাইপের বিভিন্ন স্থানের ছিদ্র দিয়ে ধীরে ধীরে গ্যাস বের হয়ে জমা হচ্ছে। আগুন কিংবা অন্য কোনো গ্যাসের সংস্পর্শে এলেই বিস্ফোরণ ঘটছে।
এবিষয়ে তিতাস গ্যাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী হারুনুর রশিদ মোল্লাহ বলেন, পুরোনো জরাজীর্ণ গ্যাস বিতরণ লাইন প্রতিস্থাপন, বিদ্যমান লাইনে কোথাও ছিদ্র থাকলে সেগুলো চিহ্নিত করে মেরামতসহ বেশকিছু কাজের জন্য প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে।
তিতাস সূত্র জানায়, ১৯৭০ সাল থেকে পাইপলাইন দিয়ে গ্যাস বিতরণ হচ্ছে। মাটির ক্ষার কিংবা লবণের কারণে পাইপগুলো ক্ষয় হয়ে অধিকাংশ জায়গায় ছিদ্র হয়ে গেছে। অনেক জায়গায় জং ধরে পাইপ মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। তৈরি হয়েছে হাজার হাজার ছিদ্র। এসব ছিদ্র দিয়ে প্রতিনিয়ত গ্যাস বের হচ্ছে। এছাড়া অবৈধভাবে ছিদ্র করে গ্যাস সংযোগ দেওয়ায় বেশিরভাগ লাইনের অবস্থা জরাজীর্ণ। এছাড়াও সম্প্রতি ৫০ হাজার অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা রয়েছে। সংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকলেও গ্রাহকের রাইজার রয়েছে। তিতাসের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী রাতের আঁধারে এসব বিচ্ছিন্ন সংযোগ ফের চালু করেছে। এসব কারণে প্রায়ই তিতাসের পাইপলাইনে বিস্ফোরণ ঘটছে।
১৯৬৮ সালে সিদ্ধিরগঞ্জ তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহের মাধ্যমে তিতাস গ্যাসের বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু হয়। তিতাসের ২০২২ সালের তখ্য অনুযায়ী, তিতাসের মোট পাইপলাইন ১৩ ৩২০ কিলোমিটার। গ্রাহক সংখ্যা ২৮ লাখ। মোট পাইপলাইনের মধ্যে রাজধানী ঢাকায় সাত হাজার কিলোমিটার। নরসিংদী, মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, শেরপুর, জামালপুর এবং কিশোরগঞ্জে তিতাসের পাইপলাইন রয়েছে।
পেট্রোবাংলার এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, ১৯৭০ সালে যখন এই পাইপলাইন স্থাপন করা হয়েছিল তখন টেকিনিক্যাল লাইফ ধরা হয়েছিল ৩০-৩৬ বছর। সে হিসাবে তিতাসের ৬০ শতাংশের বেশি পাইপলাইনের বয়স ৫০ থেকে ৫৩ বছরের অধিক। এসব বিবেচনায় নিয়ে চার বছর আগে তিতাস গ্যাসের পুরো পাইপলাইন সংস্কারের প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছিল। ওই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল প্রায় ১৪০০ কোটি টাকা। প্রতিটি পাইপলাইন স্থাপনের আগে সেগুলোর টেকনিক্যাল লাইফ বিবেচনা করে ডিপিপি (ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রপর্মা) তৈরি করা হয়। কিন্তু ৪ বছর পেরিয়ে গেলেও প্রকল্পটি এখনো অনুমোদন মেলেনি।
ইকোনমিক রিলেশন্স ডিভিশনের (ইআরডি) একটি সংস্থা আইআইএফসি (ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ফ্যাসিলিটেশন কোম্পানি) এই প্রকল্পের ড্রয়িং, ডিজাইন ও প্রাক্কলন তৈরি করে ছিল। জাপানি একটি ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করার কথা। কিন্তু অনুমোদন হয়নি।
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, ১৯৬৭-৬৮ সালে ডেমরা থেকে তেজগাঁও পর্যন্ত ১২ ইঞ্চি এবং ডেমরা থেকে পোস্তগোলা পর্যন্ত ১৪ ইঞ্চি ও ১০ ইঞ্চি ব্যাসের পাইপলাইন মাটির নিচ দিয়ে বসানো হয়। এরপর সেখান থেকে দুই ইঞ্চি থেকে ছয় ইঞ্চি ব্যাসের বিতরণ নেটওয়ার্ক স্থাপন করে গ্রাহকদের গ্যাস সংযোগ দেওয়া হয়। এখন সব পাইপলাইনের মেয়াদই শেষ হয়েছে।
পুরোনো পাইপলাইন সরিয়ে এখন নতুন পাইপলাইন বসানো জরুরি। পাইপগুলো মাটির নিচে দেওয়ার সময় এক ধরনের জং নিরোধক কালো প্লাস্টিক দিয়ে মুড়িয়ে দিতে হয়। কেউ যদি সেটি দিয়ে না মুড়িয়ে মাটির নিচে স্থাপন করে তাহলে পাইপে জং ধরে লিকেজ হতে পারে।
বর্তমানে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে প্রায় ৫০ হাজার সংযোগ আছে যেগুলোর লাইন কেটে দেওয়া হলেও গ্রাহকের রাইজার রয়েছে। এসব সংযোগ ব্যবহার করে বেশকিছু গ্রাহক পরে অবৈধভাবে পুনরায় গ্যাস সংযোগ নিচ্ছেন। এমন অবৈধ সংযোগের কারণে তিতাসের লোকসান হচ্ছে এবং বিভিন্ন সময় দুর্ঘটনা ঘটছে।
তিতাসের এক কর্মকর্তা বলেন, বিগত ২০১০ সাল থেকে সংযোগ বন্ধ থাকায় বাড়ছে অবৈধ গ্যাস সংযোগের সংখ্যা। সরকারও বাসাবাড়িতে পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাস সংযোগকে নিরুৎসাহিত করছে। এ কারণে দীর্ঘদিন ধরে বিতরণ নেটওয়ার্কের দিকে নজর কম দেয়ায় ঝুঁকি বেড়েছে। গ্যাস পাইপলাইনে এক ধরনের গন্ধযুক্ত রাসায়নিক মেশানো হয়। যাতে কোথাও লিকেজ হলে গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে এবং সাবধান হওয়ার সুযোগ থাকে। কিন্তু এ কার্যক্রম দীর্ঘ দিন বন্ধ থাকায় লিকেজ থেকে গ্যাস ছড়িয়ে পড়লেও তা জানার সুযোগ নেই।
তিনি আরো বলেন, ঢাকার গ্যাস লাইনের ওপর রাস্তা কয়েক দফায় উঁচু করা হয়েছে। রাস্তা সরু হওয়ার কারণে একই পথে অন্যান্য ইউটিলিটি সার্ভিস রয়েছে। এতে গ্যাসলাইনগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ঢাকার অনেক গ্যাসের লাইন ছিদ্র হয়ে গ্যাস স্যুয়ারেজ লাইন ও শৌচাগারের পাইপের মাধ্যমে ভবনে গিয় জমা হচ্ছে। আটকা জায়গায় জমে থাকা এসব গ্যাস পরে বিস্ফোরণ কিংবা বৈদ্যুতিক স্পার্কের মাধ্যমে বড় দুর্ঘটনা ঘটছে। সরকারি নিষেধাজ্ঞা থাকায় ২০২১-২২ অর্থবছরে নতুন পাইপলাইন স্থাপনের মাধ্যমে গ্যাস নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ করা হয়নি। তবে বিভিন্ন এলাকায় গ্যাসের স্বল্প চাপ নিরসন ও সংস্কারসহ মাত্র ৮২ কিলোমিটার লিংক লাইন সংস্কার ও প্রতিস্থাপন করা হয়।
উল্লেখ্য, গত বছরের ২৭ জুন রাজধানীর মগবাজারে একটি তিনতলা ভবনে ভয়াবহ বিস্ফোরণে ১২ জন মারা যান। আহত হন দুই শতাধিক মানুষ। ওই ভবনে থাকা অস্থায়ীভাবে বিচ্ছিন্ন একটি গ্যাস সংযোগ স্থায়ীভাবে বিচ্ছিন্ন না করায় লাইন লিকেজ হয়ে গ্যাস জমে এই বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে।
সিআইডির তদন্তেও বলা হয়, ওই বাড়ির অবৈধ গ্যাস সংযোগ শুধু রাইজার থেকে বিচ্ছিন্ন করেছিল তিতাস। কিন্তু লাইনে গ্যাসের সরবরাহ স্থায়ীভাবে বন্ধ করা হয়নি। ওই পাইপলাইনে সৃষ্ট ছিদ্র থেকে গ্যাস বের হয়ে ওই ভবনের একটি কক্ষে জমে। এটি থেকে পরে বিস্ফোরণ ঘটে।
একুশে সংবাদ/এসএপি