ইসলামি পঞ্জিকার শেষ মাস জিলহজ্জ, আর এই মাসের প্রথম দশ দিন এমন এক সময়, যেটিকে কুরআন ও হাদীসে অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ বলা হয়েছে। এ সময়ের গুরুত্ব এতই বেশি যে, মহান আল্লাহ নিজেই এ দশদিনের শপথ করেছেন: “শপথ ফজরের, আর দশ রাতের।”— (সূরা আল-ফজর: ১-২)
মুফাসসিরগণ সর্বসম্মতভাবে বলেন, এখানে ‘দশ রাত’ বলতে জিলহজ্জের প্রথম দশদিন বোঝানো হয়েছে। হাদীসেও এই দিনগুলোর ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ (সা.) স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন:“আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় দিনগুলো হলো জিলহজ্জের প্রথম দশদিন। এ সময়কার ইবাদত তাঁর কাছে সবচেয়ে প্রিয়।”— (সহীহ বুখারি: হাদীস ৯৬৯)
কেন এই দিনগুলো এত গুরুত্বপূর্ণ?
জিলহজ্জ মাসেই সংঘটিত হয়:হজ্বের মতো ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভের আনুষ্ঠানিকতা,আরাফার দিন (৯ জিলহজ্জ),ঈদুল আজহা ও কুরবানির ইবাদত (১০ জিলহজ্জ),তাকবিরে তাশরিকের আমল, ইব্রাহিম (আ.) এর ত্যাগের চূড়ান্ত নিদর্শন।
অন্য কোনো সময় এতগুলো বড় ইবাদত একত্রিত হয় না। এ সময়টিকে তাই ইবাদতের মৌসুম বলা হয়, যেখানে বান্দা অল্প আমলে বেশি সওয়াব লাভ করতে পারে।
এই দশদিনে করণীয় আমলসমূহ:
১. রোজা রাখা (বিশেষত ৯ জিলহজ্জ)আরাফা দিবসের রোজার ফজিলত অপরিসীম:“আমি আশা করি, এটি আগের এক বছর ও পরের এক বছরের গুনাহ মাফ করে দেয়।”— (সহীহ মুসলিম: ১১৬২)
যারা হজ করছেন না, তাদের জন্য এ রোজা রাখা সুন্নত। প্রথম ৯ দিন রোজা রাখাও ফজিলতপূর্ণ।
২. নফল নামাজ ও কুরআন তিলাওয়াত
তাহাজ্জুদ, ইশরাক, চাশত, সালাতুত তাসবীহ—সবই বাড়তি সওয়াবের কারণ।
প্রতিদিন কিছু সময় কুরআন তিলাওয়াতে ব্যয় করুন।
৩. জিকির, তসবীহ, দোয়া
এই সময় জিকিরের উপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে:“এই দিনগুলোতে ‘আল্লাহু আকবার’, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’, ‘আলহামদুলিল্লাহ’, ‘সুবহানাল্লাহ’ বেশি বেশি পাঠ করো।”— (মুসনাদ আহমাদ)
৪. তাকবিরে তাশরিক বলা
৯ জিলহজ্জ ফজর থেকে ১৩ জিলহজ্জ আসরের পর পর্যন্ত:
اللّٰهُ أَكْبَرُ، اللّٰهُ أَكْبَرُ، لَا إِلٰهَ إِلَّا اللّٰهُ، وَاللّٰهُ أَكْبَرُ، اللّٰهُ أَكْبَرُ، وَلِلّٰهِ الْحَمْدُ
প্রতিটি ফরজ নামাজের পর একবার বলা সুন্নত।
৫. তাওবা ও আত্মশুদ্ধি
নিজের গোনাহ থেকে মুক্তির জন্য কান্নাকাটি করে ক্ষমা চাওয়া।
হারাম ও গোনাহের পথ থেকে ফিরে এসে জীবনে পরিবর্তন আনার সময় এটাই।
৬. সদকা ও সেবামূলক কাজ
এতিম, গরিব, অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো।
খাদ্য বিতরণ, জামা-কাপড় দান, অথবা আর্থিক সাহায্য করা।
৭. কুরবানির প্রস্তুতি ও নিয়ত
কুরবানি ওয়াজিব ব্যক্তির জন্য চুল-নখ না কাটার নির্দেশ আছে (সহীহ মুসলিম: ১৯৭৭)।
কুরবানি শুধু পশু জবাই নয়, বরং তাকওয়ার প্রকাশ:“তাদের গোশত ও রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না, বরং পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া।”— (সূরা হজ: ৩৭)
হজ্ব ও আরাফা দিবসের তাৎপর্য
এই দশ দিনে হজ পালন করা হয়, যা ইসলামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতগুলোর একটি।
আরাফা দিবসকে বলা হয় “মুক্তির দিন”। হাদিসে এসেছে:“আরাফার দিনে আল্লাহ যত মানুষকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন, অন্য কোনো দিনে এত দেন না।”— (সহীহ মুসলিম)
যারা হজ করতে পারেননি, তারাও এই দিন দোয়া, রোজা ও ইবাদতে অতিবাহিত করে ফজিলত পেতে পারেন।
উপসংহার: আমলেই বদলে যাক জীবন
জিলহজ্জের প্রথম দশ দিন কোনো সাধারণ সময় নয়। এটি এমন এক বরকতময় সুযোগ, যা রমজানকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে নেক আমলের দিক থেকে। এই দশ দিন আত্মশুদ্ধি, দুনিয়াবি ব্যস্ততা থেকে বিরত হয়ে আল্লাহর পথে ফিরে আসার শ্রেষ্ঠ সময়।
আমরা যদি এই সময়টিকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারি, তবে হয়তো আমাদের জীবনের বড় পরিবর্তন এখান থেকেই শুরু হবে।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে এই সময়ের গুরুত্ব অনুধাবন করে যথাযথ আমলের মাধ্যমে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের তাওফিক দিন। আমিন।
একুশে সংবাদ /এ.জে