মৃত্যু—মানব জীবনের অবশ্যম্ভাবী বাস্তবতা। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে— “প্রত্যেক প্রাণীকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে।”
(সূরা আলে ইমরান: ১৮৫)
মৃত ব্যক্তির প্রতি সম্মান প্রদর্শন ও দাফনের কাজ ইসলামে ফরজে কিফায়া। হযরত মুহাম্মাদ (সা.) হাদিসে মৃতদের দাফনে বিলম্ব না করে দ্রুত সম্পন্ন করার নির্দেশ দিয়েছেন। ইসলামী শরিয়ত এই বিষয়ে আমাদের জন্য নির্দিষ্ট কিছু পদ্ধতি ও আদব নির্ধারণ করে দিয়েছে।
মৃতের প্রতি দায়িত্ব ও সম্মান প্রদর্শন
দাফন ইসলামি সমাজের দায়িত্ব। কেউ মারা গেলে তাকে গোসল দেওয়া, কাফন পরানো, জানাজা পড়া ও যথাযথভাবে দাফন করা ফরজে কিফায়া। কেউ যদি এটি না করে, তাহলে পুরো সমাজ গোনাহগার হয়। এমনকি মাটি না পাওয়া গেলে বিকল্প উপায়ে হলেও সম্মানজনক দাফন নিশ্চিত করতে হয়।
মৃত ব্যক্তি জীবিত অবস্থায় যেমন সম্মানিত, মৃত্যুর পরেও তার প্রতি সেই সম্মান রক্ষা করা উচিত। দাফনের সময় তার মর্যাদা ও হক আদায়ে গাফিল হওয়া অনুচিত।
কবরস্থানের পবিত্রতা ও আচরণবিধি
ইসলামে কবরস্থান শুধু মৃতের আবাস নয়—এটি জীবিতদের জন্য স্মরণ, শিক্ষা ও আখিরাতের চিন্তার জায়গা। তাই এর পবিত্রতা রক্ষা করা জরুরি। কিন্তু আমাদের সমাজে দেখা যায়, কেউ কেউ কবরের ওপর হাঁটে, বসে, এমনকি সিগারেট খায় বা খাওয়াদাওয়াও করে—যা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ও গর্হিত কাজ।
রাসুল (সা.) বলেন:
"তোমাদের কেউ যেন কবরের ওপর বসে না এবং কবরের ওপর দিয়ে না চলে। এটি যেন আগুনে বসার মতো।"
(ইবনে মাজাহ)
কবরস্থানে প্রবেশের আদব:
জুতা খুলে প্রবেশ করা উত্তম।
পবিত্র অবস্থায় (ওজু বা গোসল) থাকা উচিত।
কবরের ওপর গাছ লাগিয়ে ব্যবসা করা অনুচিত।
ওয়াকফভুক্ত জমি ব্যবহার করে ব্যবসা করা ফিকাহ অনুযায়ী হারাম।
দাফনের সুন্নাত পদ্ধতি
১. দ্রুত দাফন –
নবীজি (সা.) বলেছেন:
“তোমরা মৃতের দাফনে বিলম্ব করো না।” (বুখারি)
২. কবর খননের পদ্ধতি –
ইসলামে দু’টি পদ্ধতি রয়েছে:
ক. লাহাদ পদ্ধতি –
কিবলামুখী গহ্বর তৈরি করে মৃতকে সেখানে রাখা হয়। নবীজির (সা.) দাফন এভাবেই হয়েছিল।
খ. শাক্ক পদ্ধতি –
মাটির মাঝ বরাবর গভীর গর্ত তৈরি করে মৃত রাখা হয়। নরম মাটির জায়গায় এই পদ্ধতি গ্রহণযোগ্য।
৩. কিবলামুখী করে রাখা –
হাদিসে আছে, মৃতের মুখ যেন কিবলার দিকে থাকে। (আবু দাউদ)
`বিসমিল্লাহি ও আলা মিল্লাতি রাসুলিল্লাহ` বলা –
কবরে রাখার সময় এই দোয়াটি পড়া সুন্নত। (তিরমিজি)
৫. মাটি দেওয়া –
হাতে তিনবার মাটি দিয়ে এই আয়াতগুলো পড়া সুন্নত:
"منها خلقناكم"
"وفيها نعيدكم"
"ومنها نخرجكم تارة أخرى" (সূরা ত্বহা: ৫৫)
৬. সূরা বাকারার আয়াত পাঠ –
হজরত ইবনে ওমর (রা.) কবরের মাথার দিকে সূরা বাকারার শুরু এবং পায়ের দিকে শেষাংশ পাঠ করতেন। (বায়হাকি)
৭. পানি ছিটানো ও খেজুর ডাল রাখা –
রাসুল (সা.) দুটি কবরের ওপর খেজুরের ডাল রেখেছিলেন, যাতে আজাব লাঘব হয়। (বুখারি)
দাফনের পর করণীয়
দোয়া ও ইস্তেগফার:
রাসুল (সা.) বলতেন:
“তোমরা মৃতের জন্য মাগফিরাত চাও এবং তার জন্য স্থিরতা কামনা করো।” (আবু দাউদ)সদকা, নফল ইবাদত ও হজ:
হাদিসে আছে, কেউ মৃতের পক্ষ থেকে সদকা করলে তা তার কাজে আসে। (বুখারি)কবর জিয়ারত:
“তোমরা কবর জিয়ারত করো, তা তোমাদেরকে আখিরাত স্মরণ করিয়ে দেয়।” (মুসলিম)মৃতের দেনা পরিশোধ:
দাফনের পর তার ঋণ চুকানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আমল।
দাফন শুধু একটি শরিয়ত নির্ধারিত কাজ নয়—এটি মৃতের প্রতি সম্মান ও জীবিতদের আত্মিক জাগরণের মাধ্যম। ইসলামী শরিয়তের নির্দেশনা মোতাবেক দাফন ও কবরস্থানের আদব মেনে চললে একজন মুসলমান মৃত্যুর পরও সম্মানিত থাকেন, আর জীবিতদের জন্য তা হয় একটি মূল্যবান শিক্ষা।
লেখক: মাওলানা আসগর সালেহী