AB Bank
ঢাকা বুধবার, ২২ মে, ২০২৪, ৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

সরকার নিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল

Ekushey Sangbad
ekusheysangbad QR Code
BBS Cables
Janata Bank
  1. জাতীয়
  2. রাজনীতি
  3. সারাবাংলা
  4. আন্তর্জাতিক
  5. অর্থ-বাণিজ্য
  6. খেলাধুলা
  7. বিনোদন
  8. শিক্ষা
  9. তথ্য-প্রযুক্তি
  10. অপরাধ
  11. প্রবাস
  12. রাজধানী

ডেঙ্গুর আগ্রাসি থাবা


Ekushey Sangbad
চিররঞ্জন সরকার
০৯:০০ পিএম, ২৪ জুলাই, ২০২৩
ডেঙ্গুর আগ্রাসি থাবা

গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস বলেছিলেন, নো দাইসেলফ। মানে হচ্ছে, নিজেকে জানো। এখন দেশে যে পরিস্থিতি তাতে নিজেকে জানলে আর হচ্ছে না। এখন বেঁচে থাকতে হলে, টিকে থাকতে হলে আরো অনেক কিছু সম্পর্কে জানতে হয়। সবচেয়ে বেশি জানতে হয়, মশাকে। সক্রেটিস বেঁচে থাকলে দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে নিশ্চিত বলতেন, মশাকে জানো।


সারা দেশের মানুষ বর্তমানে মশার কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু বর্তমানে চরম আকার ধারণ করেছে। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। ডেঙ্গুর এই ভয়াবহ বিস্তারের মূল কারণ মশা। মশা মারার ক্ষেত্রে আমাদের সম্মিলিত উদাসীনতা ও ব্যর্থতার কারণেই এখন ডেঙ্গু নতুন আতঙ্ক হয়ে দেখা দিয়েছে। ইতিমধ্যে ডেঙ্গু ৫৫ জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে। সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিত্সা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিত্সকরা। হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু রোগী উপচে পড়ছে। আসন মিলছে না। মিলছে না আইসিইউ সেবা। বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকরা আশঙ্কা করছেন, আগামী নভেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুর আগ্রাসি থাবা চলমান থাকবে।


আমরা জানি, ডেঙ্গু একটি মশাবাহিত ভাইরাস রোগ। ডেঙ্গু ভাইরাসের একাধিক প্রকরণ থাকার কারণে একই ব্যক্তি একাধিক বার ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হতে পারেন এবং সেক্ষেত্রে মৃত্যুঝুঁকি অনেকগুণ বেশি। যেহেতু ডেঙ্গু জ্বরে প্রচলিত কোনো প্রতিষেধক টিকা নেই। তাই মশক নিধন ও মশার কামড় থেকে পরিত্রাণই হলো সর্বোত্তম পথ। তার মানে সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে হলে আমাদের মশা মারতে হবে। কিন্তু মশক নিধন বা মশা মারা কোনো সহজ কাজ নয়। কারণ মশার মতো বেহায়া প্রাণী আর দ্বিতীয়টি নেই। একে থাপ্পড় মারলেও কানের কাছে চলে আসে গান শোনাতে!


ডেঙ্গুর ভয়াবহ প্রাদুর্ভাবের মূল কারণ মশাকে অবজ্ঞা করা। আমাদের রাজনীতিবিদরা ক্ষমতা, শক্তিশালী রাষ্ট্রদের উপদেশ-সমর্থন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয় নিয়ে যতটা মাথা ঘামান, মশা নিয়ে তার তিল পরিমাণও ঘামান না। মশাকে সব সময় তুচ্ছ এবং অবহেলা করা হয়। অথচ জীবাণু সংক্রমণকারী এই মশাই পৃথিবীতে সবচেয়ে জীবনঘাতী পতঙ্গ। পৃথিবীতে ৩ হাজার ৫০০ প্রজাতির মশা উড়ে বেড়াচ্ছে। এসব মশার শতকরা মাত্র ৬ ভাগ হলো স্ত্রী-মশা এবং এরাই মানুষকে কামড়ায়, মানুষের রক্ত খায়। এই ৬ ভাগের অর্ধেক, অর্থাত্ মাত্র শতকরা ৩ ভাগ মশা মানুষের শরীরে রোগজীবাণুর সংক্রমণ ঘটায়। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, এই ৩ ভাগ মশা মেরে সাফ করতে পারলে লাখ লাখ মানুষের জীবন বাঁচানো সম্ভব হবে!


বিজ্ঞানীরা তো বলেই খালাস, কিন্তু মশাটা মারবে কে? মশা মারতে কামান দাগা ছাড়া আমাদের ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়ররা কিন্তু আর সবই করেছেন। ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশা নিধনে অনেক উদ্যোগ-আয়োজন, কর্মতত্পরতা, ঢাকঢোল পেটানো—অনেক কিছুই করা হয়েছে। কিন্তু তাতে কাজের কাজ কিছুই হয়নি।


আমাদের দেশের ক্ষমতাবানরা যেমন রাষ্ট্রীয় অর্থ মেরে দেওয়ার জন্য প্রতিনিয়ত নতুন নতুন প্রক্রিয়া বের করেন, মশারাও টিকে থাকার জন্য নিত্যনতুন রূপান্তরের মধ্যে দিয়ে চলে। পরিবেশগত অবস্থার কারণে ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশার জীবন চক্রে পরিবর্তন এসেছে। এতদিন বিশেষজ্ঞরা দিনের শুরুতে ও সন্ধ্যার আগে এই মশা কামড়াত বলে দাবি করলেও, নতুন গবেষণায় দেখা গেছে, এডিস মশা এখন রাতেও কামড়াচ্ছে। এর ফলে চাঁদাবাজ-সন্ত্রীদের মতো ঘাতক হিসেবে আরো শক্তিশালী হয়ে উঠেছে মশাটি।


সারা বিশ্বে মশা নিয়ন্ত্রণ করা হয় বৈজ্ঞানিক উপায়ে। কীটতত্ত্ববিদরা এ কাজে নেতৃত্ব দেন। গবেষণা করে মশার বিস্তারের নানা দিক খুঁজে বের করা হয়। এরপর কাজে নামে কর্মিবাহিনী। কিন্তু বাংলাদেশে পুরো উলটো চিত্র। সিটি করপোরেশনগুলোতে কীটতত্ত্ববিদ নেই, গবেষণাগার নেই। প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনো সক্ষমতাই গড়ে ওঠেনি। এই সুযোগে মশা অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে, ছড়াচ্ছে ডেঙ্গু বা চিকুনগুনিয়ার মতো প্রাণঘাতী রোগ।


২০১৯ সালে দেশে সবচেয়ে বেশি মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিল। সেবার প্রথম ছয় মাসে আক্রান্ত ছিল ২২২ জন। আর চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত ডেঙ্গুতে যত রোগী মারা গেছে, এই সময়ে এত রোগী আগে কখনো দেখেনি বাংলাদেশে। অথচ ‘পিক সিজন’ এখনো আসেনি। ইতিমধ্যে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ‘আউট অব কন্ট্রোল’। সিটি করপোরেশনের জোড়াতালির কাজে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না।


দেশে ডেঙ্গুর চিকিত্সা (কিউর) মোটামুটি ভালো চললেও এর প্রিভেনশনটা কিন্তু ঠিকঠাকমতো করা যাচ্ছে না। সুতরাং মশা নিধনে (প্রিভেনটিভ মেজার) সিটি করপোরেশনকে নতুন করে ভাবতে হবে। মশা এখন দেশের বড় সমস্যা; ভবিষ্যতেও মশার উপদ্রব থাকবে। এজন্য সামগ্রিকতা বিবেচনায় মশা নিয়ন্ত্রণে একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার দরকার।


মশা নিধনে সিটি করপোরেশন শুরু থেকেই নির্দিষ্ট কিছু পদক্ষেপ নিলেও (যেমন—রুটিন করে সকাল-বিকাল বিভিন্ন ওয়ার্ডে কীটনাশক স্প্রেয়িং ও ফগিং কার্যক্রম অব্যাহত রাখা) প্রশ্ন হচ্ছে, এই অপারেশন টিম বা যারা স্প্রে করছে তারা কি জানে কোন প্রজাতির মশা কোথায় কী পরিমাণ কীটনাশক প্রতিরোধী হয়েছে? তাদের কাছে কি কোনো কীটনাশক প্রতিরোধী পরীক্ষিত ডেটা রয়েছে, যা দেখে তারা রিকমেন্ডেড ডোজ প্রয়োগ করতে পারে? নাকি তারা মশা মারার জন্য কীটনাশকের ডোজ নিজেরাই ঠিক করছে বা প্রয়োজনে বাড়িয়ে দিচ্ছে? কিংবা যারা কীটনাশক প্রয়োগ করছে তারা কি ঠিকঠাকমতো প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকার মশা এখন কীটনাশক প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে। ফলে কীটনাশকে আর মশা মরছে না। যদি কীটনাশকে ভেজাল না হয়, তাহলে অল্প ডোজে কাজ হওয়ার কথা। তবে সাধারণত কীটনাশকের ভুল প্রয়োগেই (অতিরিক্ত ডোজ/অদক্ষ স্প্রেয়ারম্যান) মশারা প্রতিরোধী হয় বেশি। কারণ মাত্রাতিরিক্ত ডোজে মশারা কীটনাশক প্রতিরোধী হয়ে উঠবে, এটাই স্বাভাবিক।


মশার নিজস্ব একটা ক্ষমতা আছে কীটনাশক প্রতিরোধী হওয়ার। অতিরিক্ত প্রতিকূল পরিবেশে মশারা বাঁচার জন্য দেহের ফিজিওলজিক্যাল সিস্টেমের পরিবর্তন করতে পি-৪৫০ জিনকে (প্রতিরোধী জিন) কাজে লাগায় এবং ধীরে ধীরে প্রতিরোধী হয়ে ওঠে। কীটনাশক দিয়ে এদেরকে আর ধ্বংস করা যায় না। সুতরাং মাত্রাতিরিক্ত ডোজ যে কত ভয়ানক হতে পারে তা এখান থেকে অনুমেয়। তাই, বিভিন্ন টার্গেট এরিয়ায় মশা কী পরিমাণ কীটনাশক প্রতিরোধী হয়েছে এবং এ্ই প্রতিরোধের মাত্রা (রেজিসটেন্স রেশিও) কেমন তা গবেষণার মাধ্যমে জানতে হবে। নিয়মিত ও রুটিনমাফিক গবেষণা ছাড়া মশা নিয়ন্ত্রণ কোনোদিনই টেকসই হবে না।


মশক নিধনের ব্যাপারে আওয়াজ যতটা শোনা যায়, ধারাবাহিক কার্যকর উদ্যোগ ততটা দেখা যায় না। এর ভিন্ন কারণ থাকতে পারে। আমাদের মেয়ররা সম্ভবত স্বামী বিবেকানন্দের সেই বিখ্যাত উক্তি ‘জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর’ তত্ত্বে বিশ্বাস করেন। ক্ষুদ্র হলেও মশারাও তো জীব!


মেয়র, স্বাস্থ্য বিভাগ, নাগরিক মশা মারা শেষ পর্যন্ত কারো পক্ষেই হয়তো সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে মশা বিষয়ে আমাদের প্রচলিত মনোভাবটা বদলে ফেলতে হবে। মশাকে ক্ষতিকর হিসেবে না দেখে এর উপকারের দিকগুলো সামনে নিয়ে আসতে হবে। তাহলে মশা মারার কঠিন ও ‘হিংস্র’ পদক্ষেপ থেকে যে কোনো হূদয়বান মানুষই দূরে সরে যাবে। একবার নিজেকে মশা ভাবুন, ফগার মেশিনের অশ্লীল আওয়াজ আর ঝাঁজালো ধোঁয়ার কথা কল্পনা করুন। কী নির্মমভাবেই না মশাকে হত্যা করা হয়! আরেকভাবে ভাবুন, মশা না থাকলে আমরা হয়তো অলস সময় কাটাতাম, নিজের প্রতি যত্ন নিতাম না। মশার উত্পাত মানেই মশারি টাঙানো কিংবা কয়েল জ্বালানো। আর এই দুটি কাজই চরম অলসতার মুহূর্তে আমাদের কর্মঠ ও স্বাস্থ্যবান হতে সহায়তা করে। আর মশা মারতে হলে বিদ্যুদেবগে যে থাপ্পড় দিতে হয়, এতে আমাদের হাতেরও ব্যায়াম হয়।


টিভি দেখতে দেখতে অনেক সময় ঘুম এসে যায়। এতে মজার কোনো নাটক, টকশো বা সিনেমা মিস হয়ে যেতে পারে। কিন্তু হঠাত্ মশার কামড় আমাদের এই অসময়ের ঘুম দূর করে। কিছু মশা আছে, যারা উদ্ভিদের কাণ্ডের রস খেয়ে বেঁচে থাকে। এসব মশা উদ্ভিদের পরাগ-সংযোগে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মাকড়সা, টিকটিকি, গিরগিটি, ব্যাং, বাদুড়সহ বেশ কিছু প্রাণীর প্রধান খাদ্য এই মশা। তাই জীবজগতের খাদ্যশৃঙ্খলের ওপর মশার প্রভাব রয়েছে।


পৃথিবীতে এমন অনেক কিছুই আছে, যেগুলোর ব্যবহার পদ্ধতি আমরা এখনো জানি না। তার মানে এই নয় যে, সেটার কোনো উপকারিতা নেই। উদাহরণস্বরূপ, প্রাচীন যুগে আগুনের ব্যবহার কীভাবে করতে হয়, তা মানুষ জানত না। তখন তাদের কাছে আগুন খুবই ভয়ংকর জিনিস ছিল। কিন্তু তারা যখন আগুনের ব্যবহার শিখল, তখন সমাজ-সভ্যতা দ্রুত পালটে গেল। মশার ইতিবাচক ব্যবহার হয়তো আমরা এখনো জানি না। তার মানে এটা নয় যে, এর কোনো উপকারিতা নেই। হয়তো আমাদের ভবিষ্যত্ প্রজন্ম একদিন সেই রহস্য উদ্ভাবন করবে। তখন আমরা ঘরে ঘরে মশার চাষ করব!

 

একুশে সংবাদ/এসএপি

Link copied!