কৃষি ভান্ডার হিসেবে খ্যাত রাজশাহীর তানোর উপজেলা জুড়ে আমন ধান কাটা মাড়াই ও আলু রোপণে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে কৃষকরা। দিন রাত সমান তালে চলছে কৃষি কাজের হিড়িক। গারস্থ কৃষকদের খৈলানে বা বাড়ির আঙ্গিনায় বিশাল বিশাল ধানের পালা শোভা পাচ্ছে। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলছে সমান তালে আলু রোপনের জমি চাষ করার কাজ।সেই সাথে রাতে ধান মাড়াইয়ের কাজও চলছে জোরালো ভাবে। এক কথায় ত্রিমুখী কৃষি কাজে সময় পার হচ্ছে তানোরের কৃষকদের মধ্যে। খাওয়া, দাওয়া ও গোসলের কোন সময় নেই কৃষি শ্রমিকদের মাঝে। ফলে কদর বেড়েছে শ্রমিকদের। কারন আলুর কাজে টাকা বেশি পাওয়ার কারনে ধান মাড়াই ও বীজ তলা তৈরিতে শ্রমিক সংকট দেখা দিয়েছে।
কৃষি শ্রমিক মোস্তফা জানান, রোপা আমন ধান কেটেছি মজুরি ভিত্তিতে। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ৫০০ টাকা মজুরি পেতাম। বহিরাগত শ্রমিকরা ব্যাপক হারে ধান কাটতে এসেছিল। এজন্য অল্প সময়ের মধ্যেই ধান কাটার কাজ শেষ হয়ে গেছে। এখন আলু রোপন ও জমি তৈরির কাজ চলছে পুরোদমে। আমরা ১৬/১৭ জন শ্রমিক মিলে একসাথে কাজ করি। এক বিঘা আলু রোপনের জন্য ৪ হাজার টাকা করে নেয়া হয়। প্রতিদিন ৭/৮ বিঘা করে আলু রোপন করা যায়। একজন শ্রমিক দিনে ১ হাজার ৫০০ টাকা করে ঘরে নিতে পারছেন। ২০ থেকে ২৫ দিন মত চলবে আলু রোপনের কাজ।
আরেক শ্রমিক মুনসুর জানান, এবারে রোপা আমনের ফলন ভালো হয়েছে। বিঘায় ১৯/২০ মন করে ফলন হচ্ছে। ধানের দামও ভালো আছে। এক বিঘা জমির ধান রোপন থেকে উত্তোলন পর্যন্ত ১৫/১৬ হাজার টাকা করে খরচ হয়েছে। কারন সব কিছুর দাম বাড়তি। তবে আলু রোপন করতে গিয়ে প্রান্তিক চাষীদের ঘরে ধান থাকবে না। এক বিঘা জমির ধান বিক্রি করে ৪০ কেজির তিন বস্তাও ব্র্যাকের আলুর বীজ মিলছে না। সার বীজের ব্যাপক বাড়তি দাম। তিনি আরো জানান নিজস্ব এক বিঘা আলু রোপন করতেই ৮০/৮৫ হাজার টাকা করে খরচ হবে। আর টেন্ডারে এক বিঘা জমি রোপন করতে ৯৫ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা করে গুনতে হবে। কারন ন্যায্য মূল্যে কোন সার পাওয়া যাচ্ছে না। প্রতিটি সার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা করে বাড়তি দামে কিনতে হচ্ছে।
কামারগাঁ ইউপির কৃষক আব্দুল্লাহ জানান, চার বিঘা জমিতে রোপা আমনের ধান করে ৫০ মন ফলন পেয়েছি। কারন ঘূর্ণিঝড় দানার প্রভাব এবং পরিচর্যা না করার কারনে ফলন কম হয়েছে। তবে ওই পরিমাণ জমিতে আলু রোপন করব। কিন্তু এখন পর্যন্ত বীজ সার সংগ্রহ করতে পারিনি। একবস্তা টিএসপি সারের দাম বলছে ১৭০০ থেকে ১৮০০ টাকা করে। যে পরিমান ধান পেয়েছি বিক্রি করে টিএসপি সার জুটবে না।
এমদাদুল তিন বিঘা জমিতে রোপা আমনের ধান চাষ করে ৬০ মন ধান পেয়েছি। কিন্তু আলু রোপনের জন্য নির্ধারিত মূল্যে সার বীজ মিলছে না। ওয়াসিম আকরাম, ছয় বিঘা জমিতে রোপা আমনের ধান চাষ করে ৯০ মন ধান পেয়েছেন। আলু রোপনের জন্য কিছুই মিলছেনা।
কৃষকরা জানান, দীর্ঘ দিন ধরে আলু রোপনের আগে সিন্ডিকেট হয়। কিন্তু চলতি বছরে যে পরিমান সিন্ডিকেট কারসাজি শুরু হয়েছে, তা এর আগে দেখিনি। কোন ধরনের তদারকি না থাকার কারনে ইচ্ছে মত কারসাজি করছেন বীজ ও সার ডিলারেরা। প্রতিটি দোকানে বাড়তি দাম নিলেও কোন প্রতিকার নেই। দেশে কোন সরকার আছে বলে মনে হচ্ছে না। স্বৈরাচার সরকারের পতন হলেও দোসররা কারসাজি তে মেতে উঠেছে। প্রতিগোযীতা করে কারসাজি শুরু করেছেন। কারসাজিতে সবাই একাকার হয়ে আছে। তানোর উপজেলার বিভিন্ন এলাকার বেশকিছু ব্যবসায়ী ও কৃষকরা জানান, ডিলাররা প্রকাশ্যে কালোবাজারির মাধ্যমে ট্রাকের ট্রাক সার এনে বাড়তি দামে বিক্রি করছেন। অথচ সার নীতিমালা লঙ্ঘন করলেও কৃষি দপ্তর একেবারে নিরব ভূমিকা পালন করছেন। কারন তাদের ঘাড়ে স্বৈরাচার ভূত বসে আছে। বীজ সার নিয়ে মহা বেকায়দায় পড়েছেন আলু চাষিরা।
উপজেলা কৃষি অফিস সুত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে উপজেলায় ২২ হাজার ৫৬০ হেক্টর জমিতে রোপা আমনের ধান চাষ হয়েছে। এর মধ্যে ৭৫ জাতের ধান চাষ হয়েছে ৬৩৩ হেক্টর জমিতে, ৫১ জাতের ১০০৪১ হেক্টর, ব্রিধান ৮৭ ১২৫ হেক্টর, ব্রি৯৪ ১২১ হেক্টর ও স্বর্না ১১ হাজার ২৪৯ হেক্টর জমিতে। প্রতি হেক্টর ৬ দশমিক ৩ মে:টন ধান উৎপাদন হলে ১ লাখ ৪২ হাজার ১২৮ মে:টন ধান উৎপাদন হবে। সেই হিসেবে চাল উৎপাদন হবে ৯৩ হাজার ৮০৪ মে:টন। উপজেলার জনসংখ্যা হিসেবে বছরে ৩৩ হাজার ৫৮০ মে:টন চালের প্রয়োজন। অর্থাৎ তিন ভাগের এক ভাগ চালের প্রয়োজন বাকি দুই ভাগ রপ্তানি হয়। এটা শুধু রোপা আমনের হিসেব।
উপজেলা কৃষি অফিসার সাইফুল্লাহ আহম্মেদ জানান, চলতি রোপা আমন মৌসুমে যে পরিমান ধান উৎপাদন হবে তার দুই ভাগ রপ্তানি হবে। বিশেষ করে এবার রোপা আমন মৌসুমে ব্যাপক ভাবে মাঠে থাকার কারনে রোগ বালাই ছিলনা। তবে চলতি মৌসুমে আলু চাষের লক্ষ্যমাত্র ১৩ হাজার ১১৫ হেক্টর জমি। বীজের চাহিদা ২৯ হাজার ৫১০ মে:টন। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ৩ লাখ ৯৩ হাজার ৪৫০ মে:টন। সারের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, সরকারি হিসেবে সার প্রয়োগ হয়না। কিন্তু বরাদ্দ পায় সরকারি হিসেবে। কিন্তু সার ও বীজের বাড়তি দামের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট ভাবে লিখিত অভিযোগ পেলে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানান তিনি।
একুশে সংবাদ/বিএইচ
আপনার মতামত লিখুন :