AB Bank
  • ঢাকা
  • শনিবার, ০৬ ডিসেম্বর, ২০২৫, ২১ অগ্রহায়ণ ১৪৩২

সরকার নিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল

Ekushey Sangbad QR Code
BBS Cables
Janata Bank
  1. জাতীয়
  2. রাজনীতি
  3. সারাবাংলা
  4. আন্তর্জাতিক
  5. অর্থ-বাণিজ্য
  6. খেলাধুলা
  7. বিনোদন
  8. শিক্ষা
  9. তথ্য-প্রযুক্তি
  10. অপরাধ
  11. প্রবাস
  12. রাজধানী
বাবার স্মৃতিগুলো বেঁচে থাকার আত্মবিশ্বাস

বাবার অভাব আজও অনুভব করি



বাবার অভাব আজও অনুভব করি

২০২২ সালের ৭ ডিসেম্বর আমার শ্রদ্ধাভাজন বাবা মাওলানা মোঃ মোজাহিরুল হক (রাহিমাহুল্লাহ) সিলেটের একটি প্রাইভেট হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। আব্বার ত্যাগ-স্মৃতি হরদম মনের গ্যালারিতে ভাসলেও মৃত্যুর তারিখটি যেন কোনোভাবেই ভুলতে পারছি না।

প্রকৃতির আমোঘ নিয়মেই বাবা আমাদের ছেড়ে সাড়া দিয়েছেন আল্লাহর ডাকে।

আগামীকাল সাত ডিসেম্বর বাবা চলে যাবার চার বছর পূর্ণ হবে। এই চার বছরে প্রতিনিয়তই বাবার অপরিসীম শূন্যতা অনূভব করছি। বাবার ছায়া কত যে বিশাল সেটি বোধহয় কেবল যারা বাবা হারায় তারাই বুঝে। বুকভরা বিষণ্নতা আজও আমাদের অশ্রুসিক্ত করছে।

বাবা দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধের শব্দ। স্নেহের শীতল ছায়াতলের বটবৃক্ষের কথা মনে করিয়ে দেওয়ার মতো শব্দ। বাবাকে আমাদের ভাই-বোনেরা ‘আব্বা’ ডাকতাম, আমার কাছে মনে হতো এই সম্বোধনটাই  বেশি কোমল এবং বেশি কাছের। প্রতিটি সন্তানের বুকজুড়ে থাকে বাবার প্রতি চির অম্লান শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। এই ভালোবাসা জগতের সকল কিছুর তুলনার ঊর্ধে। বাবার মৃত্যুর পর থেকে যখন কোনো বিপদে দিশাহারা হয়ে পড়ি। অভিভাবকহীনতার কষ্টে ভোগী। কারো পরামর্শ চাইলে শুনতে হয় দেখো তুমি এখন বড় বা দায়িত্বশীল পর্যায়ে আছো, যা ভালো মনে করো তাই করো। বাবা থাকতে মনে হতো না আমি বড় হয়েছি, মনে হতো এখনো ছোট আছি। এখন মনে হয় বয়স হয়েছে, নিজেরই বড় বড় সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বাবা হারানোর ব্যথা বা বাবাহীন জীবনের কষ্ট ভয়ানক। যে বাবা হারায়নি সে এই ব্যথা বুঝবে না।

একটা সময় বছরের পর বছর বাবার স্নেহ-মমতা আর কড়া শাসনের জালে বন্দি ছিলাম। আদর করলে খুশি হতাম, আর শাসন করলে মন খারাপ করতাম। আজ বুঝি, সেই শাসনটিও ছিল ভালোবাসায় পরিপূর্ণ। অথচ আজ বাবার স্নেহ-ভালোবাসা আর শাসন করার মতো সেই মানুষটি আমার কাছ থেকে অনেক দূরে। বাবাকে কয়েক বছর ধরে হৃদয়ের গভীরে খুঁজে বেড়াচ্ছি। 

খুঁজতে খুঁজতে হয়তো আমারই সময় শেষ হয়ে আসবে, তবু বাবার হাতের স্পর্শ পাব না। কোনো মায়া মমতাতেই তো আমার বাবাকে আমরা ধরে রাখতে পারিনি। প্রতি মুহূর্তে মনের গভীরে বাবাকে অনুভব করি। মনে হয় যেন বাবা আমাদের পাশেই আছেন ছায়া হয়ে। বাবা চলে যাওয়ার পর থেকে মনে হয়, আমাদের বাবা এক বটবৃক্ষের মতো ছায়া দিয়ে রেখেছিলেন আমাদের। কিন্তু আজও বাবার স্মৃতিগুলোকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছি। বাকি জীবনের জন্য খুঁজে পাচ্ছি আত্মবিশ্বাস।

বাবাকে নিয়ে যত কথা, যত স্মৃতি যা হয়তো লিখে শেষ করা যাবে না। আবার কিছু স্মৃতি সারাজীবনের জন্য শক্তি জোগাবে। আমার দেখা সাধারণে অসাধারণ মানুষদের একজন আমার আদর্শবান বাবা। সহজ-সরল অনাড়ম্বর জীবন যাপন করা সৎ ও কর্মনিষ্ঠ এই মানুষটি আমার জীবনের আদর্শ ছিলেন। আমার বাবা আমার কাছে বিশেষ এক আবেগ, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, গর্ব। সেই গৌরব হারানোর বেদনা পৃথিবীর কোনো কিছুর বিনিময়েই প্রশমিত হবার নয়। এ এক অবর্ণণীয় শূন্যতা, যা কেবল মিশে আছে হৃদয়ের রক্তক্ষরণে। বাবা স্বশরীরে বেঁচে নেই, তবু বেঁচে আছেন আমাদের মাঝে প্রতি মুহূর্তে। আমাদের ভালোর জন্য বাবা জীবনের প্রায় সবকিছুই নির্দ্বিধায় ত্যাগ করেছেন। কখনো নিজেকে ভালো রাখার চিন্তা করেননি। 

আমার বাবা ছিলেন নিভৃতচারী মুুখলিছ আলেমে দ্বীন ও ইসলামি চিন্তাবিদ। ১৯৫৩ সালের ৮ জুলাই আব্বা জন্মগ্রহণ করেন। পাকিস্তানের করাচি মাদরাসা থেকে ১৯৭০ সালে দাওরায়ে হাদিস কৃতিত্বের সাথে সম্পন্ন করেন। পাকিস্তানের হাফিজুল হাদিস আল্লামা আব্দুল্লাহ দরখাস্তি (রহ.) এর কাছে শিক্ষা এবং বাইয়াতগ্রহণ করেন। ইলমে দ্বীনের সর্বোচ্চ ডিগ্রি সম্পন্ন করে দেশে এসে প্রথমে হবিগঞ্জের একটি মাদরাসায় শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। এরপর সত্তর দশকে শ্রীমঙ্গল উপজেলার জুলেখা নগর চা বাগান মসজিদে ইমামতি পদে যোগদেন। ১৯৮৯ সালে 

সিলেটের বরেণ্য বজুর্গ আলেম আল্লামা নুর উদ্দিন গহরপুরী (রহ.) নির্দেশে শ্রীমঙ্গল উপজেলার সিন্দুরখান ইউনিয়নের সাইটুলা গ্রামে ইসলামিয়া আরাবিয়া ইমদাদুল উলুম সাইটুলা মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠার পর থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি মাদরাসার মুহতামিম (প্রিন্সিপাল) পদে সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স ছিল ৬৯। আমৃত্যু তিনি শিক্ষকতা করেছেন। দেশ-বিদেশে বহু শিক্ষার্থী গড়েছেন। 

আমার বাবা একজন আলেমে দ্বীন ও ইসলামি চিন্তাবিদ হওয়ার কারণে তিনি দ্বীন পালনে এবং পরিবারকে দ্বীন পালনে এবং নীতি আদর্শে ছিলেন অটল।

 আদর্শবান বাবা হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালনে একটুও শিথিলতা প্রদর্শন করেননি। আমাদের পরিবারের সবাইকে দ্বীনি শিক্ষা-ধর্মকর্ম পালনে সর্বোচ্চ দায়িত্ব পালন করেছেন। মানুষ হিসেবে যেসব মৌলিক গুণ থাকা উচিত, তাঁর সব কিছুই আব্বার কাছ থেকে শিখেছি। তিনি মানুষের বিপদে-আপদে আন্তরিকভাবে পাশে থাকতেন। সারাজীবন সৎভাবে জীবনযাপন করেছেন, মানুষের উপকার করার চেষ্টা করেছেন, তার দ্বারা কখনো কারো  কোনো ক্ষতি সাধিত হয়নি। ‘কারো উপকার করতে না পারো, কখনোই কারো ক্ষতি করো না’। ছোটোবেলা থেকেই এটা সবসময়ই বাবার মুখে শুনে এসেছি। আলেম-উলামা, তার শাগরেদ ও আত্মীয়স্বজনসহ বাড়িতে কেউ এলে কখনোই তাঁকে আপ্যায়ন মেহমানদারি ছাড়া বাবা বিদায় দিতেন না। মেহমানদারি করাতে তিনি খুব পছন্দ করতেন। বলতেন রিজিকের মালিক আল্লাহ। রিজিকে যা আছে তা দিয়েই  মেহমানদারি করো। তাঁর শিক্ষকতার আদর্শই তার সমগ্র জীবনাচরণের অঙ্কুর ও শেকড়কে ধারণ করেছিল। এদিকে তার সকল মানবিক গুণাবলী, কর্তব্য-পরায়ণতা, দৃষ্টিভঙ্গির উদারতা, সাহসিকতা ও ন্যায়ের পাশে দাঁড়ানোর সমুদয় সত্যনিষ্ঠায় যর্থাথই হয়ে উঠেছিল তার পরিচয়। 

আমার আদর্শবান বাবা নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে তিলে তিলে আমাদের আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে কোনো কৃপণতা করেননি। আব্বার প্রতি আমার যে অনুভূতি হৃদয়ে ধারণ করেছি তা প্রকাশের ভাষা এখনো আবিষ্কার করতে পারিনি। আমার জীবনে যদি বলি প্রাপ্তি তবে তা হলো বাবা আমাদের মাঝে আদর্শ ও সততার বীজ বুনে দিয়েছিলেন। শিখিয়েছিলেন সততার চেয়ে নেই কিছু মহান এই পৃথিবীতে। বাবাই আমাদের শিখিয়েছেন কীভাবে হকের ওপর অটল থেকে মাথা উঁচু করে পৃথিবীতে টিকে থাকতে হয়। পরিবারের প্রতিটি বিপদে বাবাকে নতুন করে চেনার পরম সৌভাগ্য হতো আমাদের। 

‘হালাল সবসময় বরকতময়’এ কথাটি সবসময় মনে করে দিতে আব্বা। বাবা আমাদের জন্য তাঁর নীতি-আদর্শ রেখে গেছেন। আদর্শ মানে গালভরা কিছু নয়। সামান্য নিয়ে ও সততার শক্তিতে কিভাবে সবকিছু কানায় কানায় ভরিয়ে রাখা যায় এ শিক্ষা দিয়েছেন। বাবা প্রায়ই বলতেন ‘ছোট্ট একটা জীবন আনন্দময় করার জন্য সততার চেয়ে বড় আদর্শ আর কী হতে পারে’। মনে অনাবিল আনন্দ আর গর্ব নিয়ে বেঁচে থাকি এমন মুখলিস আলেম পিতার সন্তান হতে  পেরে। আব্বা ছিলেন একজন আমলদার আলেমের সবচেয়ে ভালো উদাহরণ।

আব্বার সবচেয়ে বড় গুণ হলো, তিনি কুরআন সুন্নাহ মতো জীবন পরিচালনা করতেন। পরিবারকেও এভাবে চালাতেন। হালাল হারাম বেছে চলতেন। ন্যায় ও হকের পক্ষে অবিচল থাকতেন। মেহমানকে খেদমত করতেন। জীবনে অনেক ছাত্র ছাত্রী তৈরি করে গেছেন। দেশে বিদেশে বিভিন্ন সেক্টরে তাঁর ছাত্ররা কর্মরত। আলেমদের ভালোবাসতেন, কাছে ডাকতেন পরম স্নেহ মমতা নিয়ে। কখনো কাউকে ছোট করে দেখতেন না। 

আব্বার মৃত্যুর পর তারঁ প্রতি মানুষের যে গভীর ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার অভিব্যক্তি দেখেছি, তা অতুলনীয় ও হৃদয়স্পর্শী। ভালোবাসার সম্ভবত একটি তরঙ্গ আছে। আব্বা যেমন মানুষকে ভালোবাসতেন, তারাও তেমনি ভালোবাসতেন আব্বাকে। ভালোবাসার সেই অদৃশ্য তরঙ্গ সবাইকে স্পর্শ করতো। আব্বার মৃত্যু পরবর্তী মানুষদের কাছ থেকে যে ভালোবাসা পেয়েছি, পেয়ে যাচ্ছি সেটা ভুলার মতো নয়। এগুলো আদতে অর্জন। 

আব্বা নেই আজ চার বছর পূর্ণ হয়েছে, অথচ সেই একই পরিচিতি, একই ভালোবাসা আমরা পেয়ে যাচ্ছি। এগুলো  দেখে মনে হয় আব্বা দৈহিকভাবে হয়ত নেই কিন্তু তাঁর পরিচিতি এখনও রয়ে গেছে। এগুলো দেখে একদিকে গর্ব হয়, আবার অন্যদিকে নিজেকে পিতৃহীন ভেবে বুকটা হাহাকার করে ওঠে! এই হাহাকারের যন্ত্রণা যে কতটা ভারী সেটা ঠিক টের পাই; আমি নিশ্চিত জগতের অধিকাংশ পিতৃহীনেরাই টের পায়। বাবাহীন সন্তানের জীবন যে কতটা বিয়োগান্ত হয়, তা হয়তো যাদের বাবা বেঁচে আছেন তারা কখনোই বুঝতে পারবে না। প্রতিটি মুহূর্তে মনে হয় সত্যি আমি বড়ই একা। বাবাকে ছাড়া বাঁচতে পারবো এটা কখনো কল্পনা করিনি। কিন্তু বাস্তবতা বড়ই কঠিন। বাবার জীবদ্দশায় এতটা টের পাইনি। তাঁর মৃত্যুর পর যত দিন যাচ্ছে তত বেশি করে অনুভব করছি। বুঝতে পারছি মাথার ওপর ছায়া দেওয়ার মত আকাশটা আর নেই। একটা দুঃসহকাল অতিবাহিত করছি, নীড়ে থেকেও আশ্রয়হীন। 

বাবার ভালোবাসা ও নির্দেশনায় সন্তানরা সারাজীবন আলোর পথ খুঁজে পায়। বাবাহীন জীবন বালুকাময়। সেখানে স্বস্তি নেই, শীতলতা নেই। 

হে আরশে আজিমের মালিক মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন, আপনার কাছে প্রার্থনা আব্বাকে মাফ করে জান্নাতুল ফেরদাউস দান করুন। হে আমাদের রব! তাদের প্রতি দয়া করো যেভাবে শৈশবে তারা আমাদের প্রতিপালন করেছিলেন। রাব্বিরহামহুমা কামা রাব্বা ইয়ানি ছাগিরা।

 

 

একুশে সংবাদ/এ.জে

Link copied!