AB Bank
  • ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ০৬ নভেম্বর, ২০২৫, ২১ কার্তিক ১৪৩২

সরকার নিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল

Ekushey Sangbad QR Code
BBS Cables
Janata Bank
  1. জাতীয়
  2. রাজনীতি
  3. সারাবাংলা
  4. আন্তর্জাতিক
  5. অর্থ-বাণিজ্য
  6. খেলাধুলা
  7. বিনোদন
  8. শিক্ষা
  9. তথ্য-প্রযুক্তি
  10. অপরাধ
  11. প্রবাস
  12. রাজধানী

দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশে চলনবিলের শুটকি-উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ২৭৫ টন


Ekushey Sangbad
মো. দিল, সিরাজগঞ্জ
০৩:২৮ পিএম, ৬ নভেম্বর, ২০২৫

দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশে চলনবিলের শুটকি-উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ২৭৫ টন

বন্যার পানি কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মৎস্যভাণ্ডারখ্যাত চলনবিল অঞ্চলের জনপদে এখন এক ভিন্ন চিত্র। বিলের পানি কমছে, আর সেই সঙ্গে তাড়াশ ও উল্লাপাড়ায় শুরু হয়েছে দেশীয় প্রজাতির মাছ দিয়ে শুটকি তৈরির মহাযজ্ঞ। 

এই জনপদের তিন শতাধিক চাতালে ব্যবসায়িক উদ্যম আর শ্রমিকদের অবিরাম পরিশ্রমে তৈরি হচ্ছে এক অর্থনৈতিক চালচিত্র, যা শুকনো মৌসুমে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। তবে, এই ব্যস্ততার আড়ালেই লুকিয়ে আছে মজুরি বৈষম্য, প্রাকৃতিক বিপর্যয় এবং অনিশ্চিত ভবিষ্যতের গল্প।

প্রতি বছরের মতো এবারও চলনবিলের জলজ সম্পদকে কাজে লাগিয়ে শুটকি উৎপাদনে নেমেছেন শত শত ব্যবসায়ী। সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, চলতি মৌসুমে প্রায় ২৭৫.৮০ মেট্রিক টন শুটকি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে তাড়াশ, উল্লাপাড়া এবং পার্শ্ববর্তী এলাকার তিন শতাধিক চাতালে দিনরাত কাজ চলছে।

শুটকি উৎপাদনের প্রক্রিয়াটি শুরু হয়েছে অক্টোবরের মাঝামাঝি সময় থেকে। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা সকাল বা বিকেলে চলনবিলের হাট-বাজার ও আড়ত থেকে কাঁচা মাছ কিনে চাতালে নিয়ে আসেন। এরপর শুরু হয় ধোয়া, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও শুকানোর কাজ। ব্যবসায়িক সূত্রে জানা যায়, প্রতি মণ কাঁচা মাছ প্রকারভেদে ৪ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকায় কেনা হয়। আর এই কাঁচা মাছ থেকে শুটকি তৈরির অনুপাতটিও বেশ আকর্ষণীয় তাড়াশের ব্যবসায়ীদের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি ৩ কেজি কাঁচা মাছ থেকে প্রায় ১ কেজি শুটকি তৈরি হয়।

উৎপাদিত শুটকি মাছ প্রকারভেদে ১২ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা মণ দরে পাইকারি বিক্রি করা হয়। এই শুটকি কেবল স্থানীয় চাহিদা মেটায় না, বরং এর বিশাল অংশ চলে যায় উত্তরাঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন পাইকারি আড়তে। স্থানীয় পাইকাররা জানান, চলনবিলের শুটকির বেশিরভাগই প্রথমে সৈয়দপুর আড়তে যায়। এছাড়াও উল্লাপাড়ার শুটকি জয়পুরহাট, রংপুর, ঢাকা এবং নীলফামারীতেও পাঠানো হয়, যার মাধ্যমে এটি দেশের গণ্ডি পেরিয়ে নীলফামারী আড়ত হয়ে ভারতেও রপ্তানি হয়। সিরাজগঞ্জ জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. মাহবুবুর রহমান নিশ্চিত করেছেন, সিরাজগঞ্জের শুটকির চাহিদা শুধু দেশেই নয়, বিদেশেও রয়েছে।

চলনবিলের মৎস্যসম্পদ এবং শুটকি শিল্প এই এলাকার একটি ঐতিহ্যবাহী পরিচয় বহন করে। তবে, এবারের চিত্র ভিন্ন। শুটকি ব্যবসায়ীরা বলছেন, এই মৌসুমে তাঁদের ব্যবসায়িক পরিকল্পনা ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এর প্রধান কারণ হিসেবে তাঁরা দু‍‍`টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে দায়ী করছেন যার প্রথ‌মে র‌য়ে‌ছে যত্রতত্র পুকুর খনন চলনবিলে অপরিকল্পিতভাবে এবং যত্রতত্র পুকুর খননের ফলে মাছের প্রজনন ও বিচরণ ক্ষেত্র মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।  বন্যা কম হওয়ায় পর্যাপ্ত বন্যা না হওয়ায় বিলে মাছের আমদানি বা সরবরাহ কমে গেছে।

তাড়াশ এলাকার শুটকি ব্যবসায়ী নাজমুল ইসলাম জানান, গত বছর যেখানে ৩০ থেকে ৩২ মেট্রিক টন শুটকি তৈরি হয়েছিল, এবার মাছের স্বল্পতার কারণে ১০ থেকে ১২ মেট্রিক টনের বেশি উৎপাদন সম্ভব নয়।

তাঁদের এই আশঙ্কার প্রতিধ্বনি শোনা যায় মৎস্য কর্মকর্তার কথায়ও। তাড়াশ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. মোকারম হোসেন জানান, ইতিমধ্যেই শুটকি উৎপাদন শুরু হয়েছে। তবে এ বছর মাছের সরবরাহ আগের তুলনায় কিছুটা কম। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, চলতি মৌসুমে ৭০ থেকে ৮০ মেট্রিক টন শুটকি উৎপাদনের আশা করা হচ্ছে। উল্লাপাড়া উপজেলার সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মো. আতাউর রহমান জানান, বর্তমানে সেখানে ৩০ ৩৫টি চাতালে শুটকি উৎপাদন চলছে এবং প্রতিবছর এ উপজেলায় প্রায় ৮০ থেকে ১০০ মেট্রিক টন শুটকি উৎপাদিত হয়।

শুটকি তৈরির এই বৃহৎ কর্মযজ্ঞে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। চলনবিলের প্রতিটি চাতালে ১০ থেকে ১৫ জন নারী-পুরুষ শ্রমিক কাজ করছেন, যার মধ্যে নারীদের সংখ্যাই বেশি এবং তারা এই কাজে বেশি দক্ষ বলে জানা গেছে। মাছ বাছাই করা, ধোয়া ও শুকানোর মতো অত্যন্ত সূক্ষ্ম এবং সময়সাপেক্ষ কাজগুলো মূলত নারীরাই করে থাকেন।

কিন্তু এই কঠোর পরিশ্রমের বিপরীতে তাঁরা চরম মজুরি বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। চাতালের নারী শ্রমিকদের অভিযোগ, তাঁদের মজুরি পুরুষের তুলনায় অনেক কম এবং বৈষম্যমূলক।

একজন নারী শ্রমিক দিনে পান ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। পুরুষ শ্রমিকদের মজুরি ৫০০ টাকা।

সবচেয়ে বড় বৈষম্য হলো, পুরুষ শ্রমিকদের তিন বেলা খাবার দেওয়া হলেও নারী শ্রমিকদের কোনো খাবার দেওয়া হয় না।

চাতালের নারী শ্রমিক হা‌জেরা জানান সংসারের বাড়তি আয়ের জন্য আমরা মাছ বাছাইয়ের কাজ করি। দিনে ছয় থেকে সাত ঘণ্টা কাজ করার বিনিময়ে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা মজুরি পাই। পুরুষের সমান কাজ করেও আমরা অর্ধেক মজুরি পাই, যা অত্যন্ত দুঃখজনক।

শুটকি উৎপাদন এই অঞ্চলের শত শত পরিবারের জীবিকা হলেও, মজুরি বৈষম্যের শিকার এই নারী শ্রমিকদের জীবনমানের উন্নতি এখনও সুদূরপরাহত।

চলনবিলে শুটকি তৈরির কাজ শুরু হলেও বাজারে শুটকি পুরোপুরি বাজারজাত হতে আরও মাসখানেক সময় লাগবে। শুকনো মৌসুমে এসব শুটকি দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রি হয়।

যদিও ব্যবসায়ীরা মাছের স্বল্পতার কারণে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারবেন কিনা সেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, মৎস্য বিভাগ এই শিল্পের মান নিয়ন্ত্রণে সতর্ক রয়েছে। সিরাজগঞ্জ জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. মাহবুবুর রহমান জানিয়েছেন, নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত শুটকি উৎপাদনের জন্য ব্যবসায়ীদের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে এবং নিয়মিত মনিটরিং চলছে।

উল্লাপাড়া উপজেলার বড়পাঙ্গাসীর আ‌ছের আলী বলেন, বর্ষাকালে মাছের আমদানি বেশি হয়। এলাকার হাট-বাজার থেকে মাছ কিনে এনে তারা শুটকি তৈরি করেন। তাঁদের উৎপাদিত শুটকি দেশের বিভিন্ন মোকামে যাচ্ছে।

চলনবিলের শুটকি শিল্প কেবল একটি বাণিজ্যিক কার্যক্রম নয়, এটি এলাকার সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রার অংশ। তবে, প্রাকৃতিক সম্পদের হ্রাস এবং শ্রমবাজারে বিদ্যমান বৈষম্য এই দুটি প্রধান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে না পারলে, মৎস্যভান্ডারখ্যাত চলনবিলের শুটকি-ধুম ভবিষ্যতে কেবল স্মৃতি হয়েই থাকার আশঙ্কা রয়েছে। সরকারকে মৎস্যক্ষেত্র রক্ষায় কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে এবং শিল্পে ন্যায্যতা ফিরিয়ে আনতে মজুরি বৈষম্য দূরীকরণে পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে এই গুরুত্বপূর্ণ গ্রামীণ শিল্প টেকসই হয়।


একুশে সংবাদ/এ.জে

সর্বোচ্চ পঠিত - সারাবাংলা

Link copied!