একসময় গ্রামীণ জনপদের অধিকাংশ গৃহস্থের বাড়িতেই ছিল কাচারি ঘর। কাচারি ঘর ছিল গ্রামবাংলার ইতিহাস, ঐতিহ্য, কৃষ্টি ও সংস্কৃতির একটি অংশ। কালের বিবর্তনে আজ কাচারি ঘর বাঙালির সংস্কৃতি থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। গেস্টরুম কিংবা ড্রয়িংরুমের আদি রূপ ছিল কাচারি ঘর। এখন আর গ্রামীণ জনপদে কাচারি ঘর চোখে পড়ে না।
আদিকালে মূল বাড়ি থেকে একটু দূরে খোলামেলা জায়গায় কাচারি ঘরের অবস্থান ছিল। অতিথি, পথচারী কিংবা সাক্ষাৎপ্রার্থীরা এই ঘরেই বসতেন। প্রয়োজনে এক–দু’দিন রাতযাপনেরও ব্যবস্থা থাকত কাচারি ঘরে।
কাচারি ঘর ছিল বাংলার অবস্থাসম্পন্ন ও মধ্যবিত্ত গৃহস্থদের আভিজাত্যের প্রতীক। রাঙাবালীর মরহুম আঃ রব খলিফা (কান্দার বাড়ি), ফরাজী বাড়ি, মরহুম আব্দুর রাজ্জাক চান চেয়ারম্যান বাড়ি, মরহুম চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর হোসেন আকন বাড়ি, মরহুম চেয়ারম্যান হাজী আব্দুল মন্নান হাওলাদার বাড়িসহ প্রায় প্রত্যেক বাড়িতেই ছিল কাচারি ঘর। চারদিকে ঢেউটিনের বেড়া, কাঠের কারুকাজ এবং উপরে টিন বা ছনের ছাউনি থাকত কাচারি ঘরে। প্রাকৃতিক পরিবেশে গড়া এই ঘর ছিল শীতল ও আরামদায়ক।
পঞ্চাশোর্ধ্ব ফেরদৌস নামের এক ব্যক্তি বলেন, “আমার আব্বার আমলে কাচারি ঘর ছিল সব কিছুর কেন্দ্রবিন্দু। আমাদের লেখাপড়া, ঘুম, খাওয়া-দাওয়া, কাজের লোক—সব কিছুই হতো কাচারি ঘরেই। একদিনও কাচারি ঘর ছাড়া চলত না।”
৮০ বছরের এক বৃদ্ধ জানান, “আমার ছেলেরা কাচারি ঘরেই থাকত, সেখানে লেখাপড়া করতাম, নামাজ পড়তাম, বিচার–সালিশ হতো, অতিথি এলে খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন হতো, কাজের লোকেরা রাত কাটাত—এখন সবই স্মৃতি।”
তখনকার যুগে বৈদ্যুতিক পাখা না থাকলেও কাচারি ঘর ছিল স্বাভাবিকভাবে শীতল। তীব্র গরমেও খোলা জানালা দিয়ে প্রবাহিত হতো হিমেল বাতাস। আলোচনা, সালিশ-বৈঠক, গল্প-আড্ডা—সবই বসতো কাচারি ঘরে।
আগের দিনে পারিবারিক অনুষ্ঠানে মানুষজন বেশি হলে ছেলেরা কাচারি ঘরে থাকতেন, আর মেয়েরা থাকতেন মূল বাড়িতে। বর্ষা মৌসুমে গ্রামের লোকজনদের উপস্থিতিতে কাচারি ঘরে বসতো পুঁথিপাঠ ও জারিগান। পথচারীরা সেখানে বিশ্রাম নিতেন, অনেকে বিপদে পড়লে রাতযাপনও করতেন।
গৃহস্থের বাড়ি থেকে খাবার পাঠানো হতো কাচারি ঘরের অতিথিদের জন্য। আবাসিক গৃহশিক্ষক (লজিং মাস্টার) ও আরবি শিক্ষকদের থাকার ব্যবস্থাও করা হতো কাচারি ঘরে। কোনো কোনো বাড়ির কাচারি ঘর সকালে মক্তব হিসেবেও ব্যবহৃত হতো।
ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী, ঈশা খাঁর আমলে কর্মচারীদের খাজনা আদায়ের জন্য কাচারি ঘর ব্যবহার করা হতো। জমিদারী প্রথার সময়ও গ্রামের প্রভাবশালী মোড়লদের বাড়ির সামনে কাচারি ঘরে বসেই খাজনা আদায় করা হতো।
এখন আর কাচারি ঘর তেমন দেখা যায় না। রাঙাবালীর কিছু গ্রামে এখনও অত্যন্ত জীর্ণ-শীর্ণ অবস্থায় টিকে আছে কাচারি ঘরের কিছু নিদর্শন—যা হারিয়ে যাচ্ছে সময়ের স্রোতে।
একুশে সংবাদ/এ.জে



একুশে সংবাদের সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

