চাঁদপুর নৌবন্দর দেশের অন্যতম বাণিজ্যিক কেন্দ্র, ঐতিহাসিক সংযোগস্থল এবং গুরুত্বপূর্ণ ভৌগোলিক অবস্থান হিসেবে পরিচিত। তবে দীর্ঘদিন ধরে চাঁদপুর-ঢাকা নৌরুটে চলাচলকারী লঞ্চের সেবার মান উন্নয়ন না হওয়ায় যাত্রীসংখ্যা হ্রাস পেয়েছে। এই পরিস্থিতিতে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ দ্রুতগতিসম্পন্ন নৌযান চালু এবং সেবার মান বৃদ্ধির দাবি জানিয়েছেন। বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে জেলাবাসীর পক্ষ থেকে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছেন চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক।
সোমবার (২০ অক্টোবর) সন্ধ্যায় এ চিঠি মন্ত্রণালয়ে দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোহসীন উদ্দিন।
চাঁদপুর নৌবন্দর এক সময় ডাকাতিয়া নদীর পাড়ে থাকলেও তিন নদীর মোহনাটি ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় এবং ডাকাতিয়া নদীর গভীরতা কমে যাওয়ায় শহরের নিশি বিল্ডিং এলাকায় বিকল্প বন্দরের নির্মাণ করা হয়। বর্তমানে সেখানে আধুনিক নৌবন্দর তৈরি হচ্ছে। তবে যাত্রীরা মনে করেন, আধুনিক নৌ বন্দরের পাশাপাশি নৌযানগুলোকেও আধুনিক করা প্রয়োজন।
চাঁদপুর পুরান বাজার ডিগ্রি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক দেলোয়ার আহমেদ বলেন, "চাঁদপুর-ঢাকা রুটের লঞ্চগুলোতে কোনো উন্নয়ন হয়নি। শীত বা গরম মৌসুমে এসির ভাড়া একই রকম নেওয়া হয়, কিন্তু সেবার মান বৃদ্ধি হয়নি।"
ফরিদগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা ও সমাজকর্মী শিমুল হাসান বলেন, "ঢাকা-চাঁদপুর নৌরুটে ভ্রমণ চমৎকার। তবে ভাড়া ৫০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা হলেও যাত্রী সেবার মান ভালো নয়। সেবার মান বৃদ্ধি হলে যাত্রীর সংখ্যা বাড়বে।"
শহরের পুরান বাজারের বাসিন্দা শিক্ষক ও লেখক আইরিন সুলতানা লিমা বলেন, "সড়কপথের তুলনায় লঞ্চে সময় বেশি লাগে। সড়ক পথে দুই থেকে আড়াই ঘণ্টায় ঢাকায় পৌঁছানো যায়, কিন্তু লঞ্চে সময় লাগে ৪ থেকে সাড়ে ৪ ঘণ্টা। দ্রুতগতির নৌযান এখন সময়ের দাবি।"
কুমিল্লা সড়কের বাসিন্দা ও ব্যবসায়ী আবু বকর ছিদ্দিক বলেন, "দ্রুত নৌযান চালু এবং সেবার মান উন্নত করলে যৌক্তিক ভাড়া নেওয়া সম্ভব। তবে বর্তমানে সেবার মান খুবই খারাপ। এক সময় লঞ্চের ভ্রমণ সবার কাছে প্রথম পছন্দ ছিল।"
চেয়ারম্যানঘাট এলাকার বাসিন্দা ও ব্যবসায়ী এ.ওয়াই.এম. জাকারিয়া বলেন, "চাঁদপুর নৌবন্দর নির্মাণ এবং লঞ্চের যাত্রীসেবা বৃদ্ধির প্রয়োজন অনেক আগে থেকেই ছিল। বর্তমানে নতুন আধুনিক নৌবন্দর নির্মাণ এবং দ্রুতগামী নৌযান দিলেও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা কম বলে মনে হয়।"
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোহসীন উদ্দিন ১৬ অক্টোবর নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে দেওয়া চিঠিতে উল্লেখ করেছেন, "ঢাকা থেকে বরিশাল বিভাগের সব জেলা এবং চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ঢাকাসহ সারা দেশের লঞ্চ, কার্গো ও জাহাজ চলাচলের ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে চাঁদপুর নদীবন্দর ব্যবহৃত হয়। চাঁদপুর শহর পদ্মা, মেঘনা ও ডাকাতিয়া নদীর মোহনায় অবস্থিত এবং ইলিশের বাড়ি হিসেবে পরিচিতি পাওয়ায় ভ্রমণপিপাসু মানুষের কাছে এটি আকর্ষণীয় পর্যটন স্থান।"
বর্তমানে নদীপথে চাঁদপুর-ঢাকা যাতায়াতে সাড়ে ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা সময় লাগে, যেখানে সড়কপথে দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা লাগে। ধীরগতির পুরোনো লঞ্চের কারণে নদীপথে দীর্ঘ সময় ব্যয় হয়, ফলে জনসাধারণ নদীপথে যাতায়াত কমাচ্ছেন। নদীপথ তুলনামূলক কম ব্যয়বহুল, আরামদায়ক ও নিরাপদ। দ্রুতগতির লঞ্চ চালু হলে এই সময় কমিয়ে আড়াই ঘণ্টার মধ্যে যাতায়াত করা সম্ভব।
এছাড়া বেশিরভাগ লঞ্চে নিম্নমানের আসন, অপ্রতুল লাইফ জ্যাকেট, অপরিষ্কার শৌচাগার ও অস্বচ্ছন্দকর অভ্যন্তরীণ পরিবেশ রয়েছে। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে চাঁদপুর আধুনিক লঞ্চ টার্মিনাল উন্নয়ন প্রকল্প চলমান। তবে সাধারণ মানুষ লঞ্চে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ না করলে উন্নত লঞ্চ টার্মিনাল নির্মাণেও আশানুরূপ ফল পাওয়ার সম্ভাবনা কম।
ডিসি মোহাম্মদ মোহসীন উদ্দিন বলেন, "চাঁদপুর-ঢাকা নৌরুট সচল রাখার জন্য আধুনিক ও দ্রুতগতিসম্পন্ন লঞ্চ চালু করা, লঞ্চ সংস্কার, সেবার মান বৃদ্ধি, আধুনিকায়ন এবং আড়াই ঘণ্টার মধ্যে যাতায়াত নিশ্চিত করার ব্যবস্থা গ্রহণ প্রয়োজন।"
তিনি আরও বলেন, "চাঁদপুর ছাড়াও শরীয়তপুর ও লক্ষ্মীপুর জেলার জনগণ এই রুট ব্যবহার করেন। সড়কপথের চাপ কমাতে হলে নৌরুটের সেবার মান বৃদ্ধি করা আবশ্যক, অন্যথায় ভবিষ্যতে যাত্রী কমে লঞ্চ সেবা বন্ধ হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।"
একুশে সংবাদ/এ.জে